Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
একুশ শতকের ভারতে আছেন ৪০ লক্ষ ‘মডার্ন স্লেভ’

আধুনিক ক্রীতদাস

ছোটু ক্রীতদাস, নিখুঁত করে বলতে গেলে— আধুনিক ক্রীতদাস। মডার্ন স্লেভ। শব্দটা শুনলে বুকের ভেতরটা চলকে ওঠে, কারণ দাস কথাটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বাধীনতাহীনতা, নিপীড়ন, অত্যাচারের লম্বা ইতিহাস।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩২
Share: Save:

দু’নম্বর টেবিলে ব্রেড-ওমলেট, চার নম্বরে একটা ঘুগনি, পাঁচে দুটো লিকার আর তিন নম্বরে লুচি-পুরি-জিলিপি— চোস্ত ছোটু দু’হাতে ব্যালেন্স করে টেবিলে টেবিলে দিয়ে দেয় ‌‌খদ্দেরদের ফরমায়েশ। ছোটুর মা জোর করে দিয়ে গিয়েছে চায়ের দোকানে। কবে? ছোটুর তেমন মনে নেই। ছোটুর বাবা ধার নিয়েছিল দোকান মালিকের থেকে। শোধ দেওয়ার আগেই ট্রাকে চাপা খেয়ে দু’পা খুইয়েছে। মালিক কম তম্বি করেনি। টাকা না দিতে পেরে, ছোট ছেলেটাকে দিয়েছিল গতরে খেটে পু‌ষিয়ে দেবে, এই প্রতিশ্রুতিতে। তাই বিনে মাইনেয় কাজ করে চলেছে ছোটু। পয়সা পায় না, দেড় বেলা মতো খেতে পায়। মনে তেমন দুঃখু নেই ছোটুর। টিভিতে তো সলমন খান দেখতে পায়।

ছোটু ক্রীতদাস, নিখুঁত করে বলতে গেলে— আধুনিক ক্রীতদাস। মডার্ন স্লেভ। শব্দটা শুনলে বুকের ভেতরটা চলকে ওঠে, কারণ দাস কথাটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বাধীনতাহীনতা, নিপীড়ন, অত্যাচারের লম্বা ইতিহাস। অবশ্য ছোটুরা সব্বাই যে ক্রীতদাস, এমনটা বলা যাবে না। আবার কেবল ছোটুরাই যে আধুনিক ক্রীতদাস, তা-ও নয়, এই দলে রয়েছেন বিভিন্ন ধরনের মানুষ। ‘মডার্ন স্লেভারি’র একটা সংজ্ঞা আছে। বেগার শ্রম, পাচার, বলপূর্বক শ্রম, জোর করে বিয়ে, হিংসার শিকার হয়ে কাজ করতে বাধ্য— ইত্যাদি কয়েক রকমের পদ্ধতিতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে শ্রম দান করছেন যে মানুষ, তিনিই আধুনিক ক্রীতদাস। তিনি বেআইনি ভাবে আমেরিকায় এসে সে দেশের কৃষি-জমি ও ফলের বাগানে খাটতে বাধ্য হতে পারেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের সেই শ্রমিক হতে পারেন যিনি মহাজনের টাকা শোধ দিতে না পেরে মহাজনের জমিতে পারিশ্রমিক ছাড়া খাটেন, হতে পারে সেই সব মেয়ের এক জন যারা পাচার হয়ে যায়, যাদের মা-বাবা পয়সার জন্য কিশোরী মেয়ের বিয়ে দেন (পরে তাদের অনেকেই পাচার হয়ে যায়), হতে পারে সেই বাচ্চাটি যে মায়ের কাজের বাড়িতে বিনি পয়সায় বাজার-দোকান করে, গৃহকর্ত্রী যাকে দিয়ে মায়ের মাইনেতেই কাপড় কাচিয়ে নেন হয়তো দুটো রুটির বিনিময়ে, আবার হতে পারে সেই শিশু-যোদ্ধা, ‘আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে’ যে আল-কায়দায় নাম লিখিয়েছে কিংবা সোমালিয়া বা সিরিয়ায় বন্দুক তুলে নিয়েছে হাতে।

এই আধুনিক ক্রীতদাসদের নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে একটা আন্তর্জাতিক সমীক্ষা হয়ে আসছে। সর্বশেষ সমীক্ষাটির ফল বেরিয়েছে সম্প্রতি। সেই ফলাফল বলছে, পৃথিবীর আনাচেকানাচে আধুনিক দাসপ্রথার রমরমা চলছেই। জনসংখ্যার অনুপাতে ক্রীতদাসের সংখ্যা বিচারে সব চেয়ে উপরে উত্তর কোরিয়া। সেই বিচারে ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৫৩ নম্বরে। খুব গৌরবের নম্বর নয় সেটা, তবে সে লজ্জা গৌণ। আসল খবর হল, ক্রীতদাসের মোট সংখ্যায় ভারত হচ্ছে সব চেয়ে ওপরে। ৮০ লক্ষ! হ্যাঁ, ভারতের অন্তত এত মানুষ দাসপ্রথায় জড়িত। আসল সংখ্যাটা হয়তো আরও বেশি, সাধারণত তো তা-ই হয়, সব নিপী়ড়ন, সব যন্ত্রণা কবে আর হিসেবের খাতায় ধরা পড়েছে? সমীক্ষা বলছে, পৃথিবী জুড়ে প্রায় চার কোটির একটু বেশি দাস রয়েছে। তার মধ্যে ৪ লক্ষ রয়েছে এক নম্বর দেশ, আমেরিকায়। যেখানে কিনা ১৮৬৩ সালে, প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিঙ্কন— সেই গৃহযুদ্ধের মধ্যেই— ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, মুক্ত হয়েছিলেন ৪০ লক্ষ কালো মানুষ। সেই দেশে আজও চার লাখ ক্রীতদাস। আধুনিক ক্রীতদাস।

এটা সম্ভব যে, এই আধুনিক ক্রীতদাসদের সংখ্যাটা সাম্প্রতিক দুনিয়ায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। শরণার্থীরা তার একটা বড় কারণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু বহু মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। ঘরের কাছে আছেন রোহিঙ্গারা, ঠিকানা হারিয়ে অনিশ্চিত দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা, লক্ষ লক্ষ অসহায় অ-নাগরিক। ও দিকে আছে বিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়া— এক সিরিয়ার যুদ্ধের ফলেই লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্য দেশে আশ্রয় খুঁজেছেন। উত্তর আফ্রিকার নানা দেশ থেকেও কখনও দারিদ্রের জ্বালায়, কখনও নতুন জীবনের আশ্বাসে প্রাণ হাতে করে নৌকায় পাড়ি দিতে চেয়েছেন অতলান্তিক। তরী ভিড়েছে গ্রিসের দ্বীপে কিংবা ইতালির কূলে। পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে খেদানি খেতে হয়েছে। কেউ কেউ উপায়ান্তর না দেখে, নিজের আর সন্তানদের পেটের জ্বালা মেটাতে আধুনিক ক্রীতদাসের দলে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। খাবার জোটাতে, কাজ খুঁজতে মরিয়া মানুষ হয়তো বেগার শ্রমে রাজি হয়েছেন।

এ তো গেল অন্য দেশের কথা। কিন্তু ভারতের ব্যাপারটা ঠিক কী? এখানে তো লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এসে আশ্রয় নেয়নি, এখানে তো ইদানীং এমন কিছু হয়নি, যার জন্য মানুষকে সব হারিয়ে বাধ্য হয়ে আধুনিক ক্রীতদাস প্রথায় যুক্ত হতে হবে? তা হলে ভারতে আধুনিক ক্রীতদাসের সংখ্যাটা এত বেশি হল কী করে? সংশয় নেই, আগে থেকেই, বহু কাল ধরেই এ জিনিস বিদ্যমান ছিল। তর্কবাগীশরা বলবেন, ভারতের লোকসংখ্যা বেশি, সুতরাং সেই অনুপাতে ক্রীতদাস বেশি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। সরল অঙ্ক। তা হলে এই অঙ্ক মেনে তো অলিম্পিক্স-এ ভারতের মেডেলও বেশি পাওয়া উচিত, তাই না? আর, চিনের লোকসংখ্যা তো কম কিছু নয়, তা হলে ক্রীতদাসের সংখ্যায় চিনের স্থান ১৬৭-র মধ্যে ১১১ নম্বর স্থানে কেন?

সদুত্তর নেই। আর নেই বলেই মহামান্য ভারত সরকার এই সংখ্যাটা মেনে নিতে নারাজ। সমীক্ষার ফলাফলে গোসা হয়েছে তাঁদের। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এ সমীক্ষার পদ্ধতি এবং ব্যাখ্যায় গলদ রয়েছে— ঠিক পদ্ধতি, ঠিক ঠিক পরিমাপক ব্যবহার করা হয়নি এই সমীক্ষায়। হতেই পারে। পদ্ধতি ভুল হতে পারে, পরিমাপকও ভুল হতে পারে। তাতে ক্রীতদাসের সংখ্যা দু’পাঁচশো, কিংবা দু’পাঁচ হাজার এ দিক-ও দিক হবে, এমনকি ৮০ লক্ষটা কমে ৭৯ লক্ষ হতে পারে (ঠিক যেমন হতে পারে ৮১ লক্ষও), কিন্তু বৃহত্তর চিত্রটা বদলে যাবে কি? পাচার করা মেয়েগুলো রাতারাতি বাড়ি ফিরবে? বাপ-ঠাকুরদার দেনার দায়ে বেগার খেটে চলা খেতমজুরকে তাঁর মনিব মুক্তি দেবে? কোনও ছোটু আর চায়ের দোকানে আসবে না তো?

না, আসলে এ সব কিছুই হবে না। যেমন চলছে, তেমনই চলবে। কারণ এই চিত্র বদলানোর জন্য যতটা নড়েচড়ে বসার দরকার, সরকার কোনও দিনই ততটা নড়াচড়া করবে না। তত দিন বিশ্বের দরবারে, এ রকম নানান সংখ্যার সম্মিলিত আগুনে, ভারতের মুখ পুড়বে, পুড়তেই থাকবে। কিন্তু এতটা লজ্জা যে ভারতের হল তাতে কি ভারতের সত্যিই কিছু এসে গেল? না। বরং, এই সমীক্ষা কতটা ভুল, সরকার তা দাগিয়ে দিতে উৎসাহিত হল। মেনে তো নিলই না বরং ভুল ধরতে তৎপর হয়ে উঠল। এই তৎপরতাই সরকারের চরিত্রটা বলে দেয়। কতটা নির্লজ্জ হলে, সংখ্যাটার দিকে তাকিয়ে, তাকে শুধরানোর কথা না ভেবে সংখ্যাটাকে অস্বীকার করা যায় নানা অজুহাতে!

আর শুধু সরকারই বা কেন, বিরোধী দলেরও তো কেউ কিছু বললেন না! রিপোর্ট বেরিয়েছে, কয়েক মাস হয়ে গেল, এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তর্কাতর্কি হয়েছে, এমনটা তো শুনিনি। এমনকি আমরা যারা সংবেদনশীল মানুষ বলে নিজেদের দাবি করি, তারাও কি এই বিষয় নিয়ে সচেতন হয়েছি? প্রতিবাদ করেছি? সুবিচার চেয়ে পথে নেমেছি? নামিনি। কারণ আমরাও এই বাস্তবটা মেনে নিয়েছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনও না কোনও ভাবে স্বাভাবিক বলেই মনে করেছি। আমাদেরও যেন কিছুই এসে যায় না। একটা গোটা দেশের চরিত্র যদি এই রকম মেনে নেওয়া গোছের হয়, তা হলে সেই দেশের সংখ্যাগুলোও এই রকমই চোখ কপালে তোলার মতোই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labour Child Modern day Slaves
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE