Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

গঙ্গা-পদ্মায় হারিয়ে গেল আস্ত শিবনারায়ণ

বাণিজ্যের জন্যও শিবনারানকে ব্যবহার করা হত। নদের পাশে গড়ে উঠেছিল বড় বাণিজ্যকেন্দ্রও। তবে মানব-জীবনে সমৃদ্ধি এনেও নিজেকেই আর ধরে রাখতে পারল না সে। শেষে হারিয়ে গেল নামটাও। লিখছেন সুপ্রতিম কর্মকারশিবনারান নদটিকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮০ সালে প্রকাশিত  রেনেলের ‘ম্যাপ অব দ্য কাশিমবাজার আইল্যান্ড’ মানচিত্রে। এই মানচিত্রে দেখা যায় শিবনারান নদটা গঙ্গার জল ছাড়াও ভাগীরথী নদীরও জল পেত।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৪
Share: Save:

নদটার নাম ছিল শিবনারান। ধরেই নেওয়া যায়, শিবনারায়ণ ধাক্কা খেয়ে নাম বদলেছে। নবাবগঞ্জের কাছে মহানন্দা যেখানে গঙ্গাতে মিশছে ঠিক তার উল্টো দিকে নারায়ণপুরের কাছে গঙ্গা থেকে শিবনারান নদের জন্ম হচ্ছে। তার পরে নদটা শেখলিপুরের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর প্রবাহিত হয়। গোবিন্দপুরের কাছে এসে পূর্ব দিক বরাবর সামান্য বাঁক নিয়ে মীনকূট, শাকরাল, চাঁদপুর, পুরনো ভগবানগোলার কাছে এসে নদটা পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ভগবানগোলার কাছে এসে নদটা ফের গঙ্গার সঙ্গে মিশছে।

শিবনারান নদটিকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮০ সালে প্রকাশিত রেনেলের ‘ম্যাপ অব দ্য কাশিমবাজার আইল্যান্ড’ মানচিত্রে। এই মানচিত্রে দেখা যায় শিবনারান নদটা গঙ্গার জল ছাড়াও ভাগীরথী নদীরও জল পেত। গোবরা বলে একটি নদী ভাগীরথী থেকে জল বয়ে এনে গোবিন্দপুরের কাছে শিবনারান নদকে জল দিত। এ ছাড়াও এই সময় গোবরা নদী ও শিবনারান নদ প্রায় একই পরিমাণ জল বহন করত। নদীটার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৭.০১ কিলোমিটার বা ২৩ মাইল।

শিবনারান নদ যে সময় প্রবাহিত হচ্ছে সেই সময় শেখলিপুরের কাছে গঙ্গা দু’ধারায় বিভক্ত ছিল। একটি ধারা বয়ে যেত শেখলিপুরের পাশ দিয়ে। আর অন্য ধারাটি বয়ে যেত নীলকান্তপুরের পূর্ব দিক দিয়ে। ১৭৮০ সালে গঙ্গার মূল ধারাটি নীলকান্তপুরের পূর্ব দিকের ধারাটিই ছিল। গঙ্গার পশ্চিম দিকের ধারাটি থেকে শেখলিপুরের উপর দিয়ে বয়ে চলা শিবনারানের দূরত্ব ছিল ৪.৫ মাইল। আর লালগোলা ঘাট ও শাকেলপুর কাছে গঙ্গার মূল ধারা ও শিবনারানের মধ্যে দূরত্ব ছিল যথাক্রমে ৫ মাইল ও ৫.৫ মাইল।

শিবনারান নদের মোহনাটি সম্পর্কে দুটো কথা বলা দরকার। শিবনারান নদটা গঙ্গার সঙ্গে যেখানে মিশছে ঠিক সেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে কলকলি নদী। অর্থাৎ শিবনারানের মোহনা ও কলকলির উৎসমুখ এক। গঙ্গার সমান্তরালে বয়ে চলা শিবনারান নদটার জন্ম হয়েছিল কী ভাবে, সে কথা জানতে একটু অতীতের ইতিহাসের দিকে ফিরে চাইতে হবে।

শিবনারানের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের ইতিহাস। নদীর সারস্বত সাধনায় অতীত কালের মানচিত্র পাঠই আমদের নদীর ইতিহাস জানার একমাত্র সম্বল। ফান–ডেন-ব্রুকের ১৬৬০ সালের মানচিত্রে আমরা দেখি রাজমহলের কিছুটা দক্ষিণ থেকে আরম্ভ করে কাশিমবাজার পর্যন্ত গঙ্গার তিনটি ধারা ছিল। গঙ্গার এই তিনটি দক্ষিণ বাহিনী শাখার জল কাশিমবাজারের একটু উত্তর থেকে একসঙ্গে প্রবাহিত হয়ে সোজা দক্ষিণ দিক দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছিল। ডেলিসলি যখন বাংলার নদী জরিপ করছেন তখন ১৭২০ সাল। তাঁর মানচিত্রটি প্রকাশিত হয় ১৭৪০ সালে। ডেলিসলির মানচিত্রে দেখা যাবে সেই সময় রাজমহল পাহাড় থেকে কাশিমবাজার পর্যন্ত গঙ্গা কিছুটা পূর্ব দিকে সরে গিয়েছে। ১৭৩০ সালে টিরিয়নের মানচিত্রেও গঙ্গার পূর্ব দিকে সরে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

আর সেই প্রবণতা ১৭৫২ সালে ডি-আই-আইভিল-এর মানচিত্রেও ধরা পড়ছে। এই মানচিত্রেও গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের ধারাটিকে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ দেখা যাচ্ছে। ১৭৮০ সালে রেনেলের ‘ম্যাপ অব দ্যা কাশিমবাজার আইল্যান্ড’ মানচিত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি গঙ্গা সুতি থেকে জলঙ্গি পর্যন্ত অনেকটা পূর্ব দিকে সরে এসেছে। এ ছাড়াও শিবনারান নদটার অস্তিত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। রেনেল তাঁর মানচিত্রে গঙ্গার পুরোনো ধারাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন। যে ধারাটি বীরানপুর, চাঁদপুর, তেলিয়া, বাহাদুরপুর, শুঙ্গরপুর হয়ে প্রবাহিত হত। অর্থাৎ অতীত কালের গঙ্গার একটি ধারাই শিবনারান নদ। সম্ভাব্য ১৭৫২ সালের পরবর্তী সময়ে শিবনারানের জন্ম হচ্ছে। তার আগে কোনও মানচিত্রেই শিবনারান নদকে আমরা খুঁজে

পাচ্ছি না। এক সময়ের খুব সমৃদ্ধশালী নদ ছিল শিবনারান। বাণিজ্যের জন্যও ব্যবহার হত এই নদ। নদের পাশে গড়ে উঠেছিল বড় বাণিজ্যকেন্দ্রও। যেমন লালগোলা, শাকরাল প্রভৃতি। এ বার প্রশ্ন হল, কী ভাবে হারিয়ে

গেল নদটা। শিবনারান নদের হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাসটা বেশ আকর্ষণীয়। তার কারণ, একটা নদের হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আর একটা নদীরই ভূমিকা রয়েছে। আর সেই নদীটার নাম যদি গঙ্গা হয়, তা হলে আকর্ষণটা একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। শিবনারানের হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাসটা শুরু হয়েছিল ১৭৮০ সালের পর থেকে। ১৮০১ সালে ভাগীরথী নদী দুটো স্থানে গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই বছরের শেষের দিকে গঙ্গার ভাঙ্গন শুরু হয়। কোলব্রুক সাহেবের লেখা থেকে জানা যায়, সেই সময় গঙ্গা ৪০ বর্গ মাইল বা ২৫৬০০ একর জমি গ্রাস করে নিয়েছিল। ১৮২৮ সালে ভাগীরথীর উৎসমুখটি ছিল সুতি থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ফরাক্কার কাছে। ১৮২৫ সালে ফরাক্কার দক্ষিণে গঙ্গা গতিপথ পরিবর্তন করে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সরে আসে। আর এই সময় গঙ্গা ভাগীরথী নদীর বেশ কিছুটা অংশ গ্রাস করে নেয়। গঙ্গার এই গ্রাসেই মুখে পড়ে শিবনারান নদও। আর এই কারণেই শিবনারানের উৎসমুখের দিক থেকে অনেকটা অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ।

১৮২৫ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ভাগীরথীর উৎস মুখটি আরও পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হয়। এই সঙ্গে গঙ্গার মূল ধারাটি কিছুটা পূর্ব দিক বরাবর সরে যায়। ১৮৩২ সালে রয়াল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি প্রকাশিত জার্নালে জন ম্যারে ও সেন্ট আলবিমার্লে সাহেবেরা যৌথ ভাবে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন। সেই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ভাগীরথীর উৎস মুখ অনেকটা সরে চোখার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আর শিবনারান নদের এক তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন। তার কারণ পশ্চিম পাড় বরাবর গঙ্গার ভাঙ্গন। ১৮৫২ সালে গঙ্গা আরও পশ্চিমে এগিয়ে আসে। ১৮৭৫ সালে থুইলারের মানচিত্রে দেখা যায়, লালগোলার কাছে শিবনারান নদের কিছুটা অংশ মরা পদ্মা নদী হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই মরা পদ্মা নদী থেকেই ভৈরব নদীর জন্ম দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও পদ্মার মূল স্রোত লালগোলা থেকে ৩.৫ মাইল বা ৫.৬ কিলোমিটার উত্তরে সরে গিয়েছে।

১৮৮৩ সালের পর থেকে ভৈরব নদীর উৎসমুখে জলের সমস্যা ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে একটা বড় বন্যা আসে। আর তাতেই নদীগুলোর আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। পদ্মা থেকে ভৈরবের নতুন উৎস মুখ তৈরি হয়। পদ্মা আরও পশ্চিম দিকে সরে আসে। মরা পদ্মার পুরনো খাতের কিছুটা অংশে পদ্মা নদীর মূল স্রোত সরে আসে। আর কিছুটা অংশ পলি পড়ে সম্পূর্ণ বুজে যায়। নদীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলোপ পায়।

শিবনারান নদটা এ ভাবেই হারিয়ে গেল গঙ্গা-পদ্মা নদীর মধ্যেই। নদী পাড়ের মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি এনেও নিজেকেই আর ধরে রাখতে পারল না সে। শেষ জীবনে নিজের নামটাও হারিয়ে ফেলল। আর ১৮৮৫ সালের বন্যাতে হারিয়ে গেল তার সর্বস্ব।

নদী বিশেষজ্ঞ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

River Shib Narayan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE