Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আসল প্রশ্ন

সুদীপ্ত মাণ্ডল কমিটির তৈরি পরিসংখ্যানকে মুছিয়া সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজ়েশনের তথ্য সাজাইয়া দিয়াছেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলি। ছবি: পিটিআই।

অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলি। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২৮
Share: Save:

দুর্জনে বলিতেই পারে, মিথ্যা এবং ডাহা মিথ্যাতেও শানাইতেছে না দেখিয়া বিজেপি এখন পরিসংখ্যানের শরণাপন্ন। সুদীপ্ত মাণ্ডল কমিটির তৈরি পরিসংখ্যানকে মুছিয়া সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজ়েশনের তথ্য সাজাইয়া দিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। মাণ্ডলের জিডিপি ব্যাক সিরিজ় বলিতেছিল, বর্তমান এনডিএ আমলের তুলনায় মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জমানায় আর্থিক বৃদ্ধির হার অধিকতর ছিল। কথাটি দৃশ্যত শাসকদের পছন্দ হয় নাই। সরকারি ওয়েবসাইট হইতে রাতারাতি সেই হিসাব সরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। ফের অঙ্ক কষিয়া, খানিক ভগ্নাংশ আর খানিক ত্রৈরাশিকের প্যাঁচে নূতন পরিসংখ্যান আসিয়াছে। তাহাতে ইউপিএ জমানার বৃদ্ধির হার অনেকখানি কমিয়া গিয়াছে। অর্থমন্ত্রী বলিয়াছেন, সিএসও অতি সম্মানজনক সংগঠন, এবং তাহারা সরকারের সহিত নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলে। অস্যার্থ, সিএসও-র পরিসংখ্যানে জল নাই, তাহাকে ভরসা করা চলে। কিন্তু, ভরসা করিবার উপায় আর থাকিল কোথায়? কর্পোরেট ক্ষেত্রের আয়বৃদ্ধির হার, বাণিজ্যের পরিমাপ, শেয়ার বাজারের চলনের হিসাব— সিএসও-র হিসাবের সহিত কিছুই খাপ খাইতেছে না। যেমন, ইউপিএ আমলে ভারতে কর্পোরেট ক্ষেত্রে রাজস্ব বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার ছিল ১৮.৯ শতাংশ, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তাহা কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ৫.২ শতাংশে। শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত ৭৯৯টি সংস্থার নেট লাভের বৃদ্ধির হার দুই জমানায় যথাক্রমে ১৩.২ শতাংশ ও -১.৮ শতাংশ। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় লাভ বাড়ে নাই, কমিয়াছে। ব্যাঙ্ক ঋণ, মূলধনী খাতে ব্যয়, শেয়ার বাজারের সূচক, রফতানি বা প্রত্যক্ষ কর আদায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির অঙ্কে ইউপিএ জমানা বহু ধাপ আগাইয়া। এবং, প্রতিটি হিসাবই সুদীপ্ত মাণ্ডল কমিটির হিসাবের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ। এ ক্ষণে প্রশ্ন, শুধু অর্থমন্ত্রীর মুখের কথায় এতগুলি প্রমাণকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে কি?

রামমন্দিরের হুঙ্কারেও যদি ভোটের দেবতা জাগ্রত না হন, তবে অর্থনীতিই ভরসা। কিন্তু, তাহার জন্য অতীতের পরিসংখ্যান ঘাঁটিবার প্রয়োজন নাই। বৃদ্ধির হারে রাজনীতির জল ফুটিতে পারে, তাহাতে গরিবের ভাত চড়িবে না। অর্থনীতির উন্নতির সহিত সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র কেবলমাত্র কর্মসংস্থান। চাকুরি পাইলে তবেই সাধারণ মানুষের ঘরে আর্থিক বৃদ্ধির ছিটেফোঁটা ঢুকিবার সুযোগ হয়। নরেন্দ্র মোদী বৎসরে এক কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। শেষ অবধি রাস্তার ধারে পকোড়া ভাজিবার কাজটিকেও কর্মসংস্থানের হিসাবে ঢুকাইয়া লইয়াছেন, তবু সেই এক কোটি দূর অস্ত্। যাবতীয় পরিসংখ্যান বলিতেছে, এই জমানায় চাকুরির ছবিটি অতি ম্লান। নোটবাতিল এবং জিএসটির ধাক্কায় তাহা ম্লানতর হইয়াছে। কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার অনুপাত ০.১-এর কাছাকাছি। অর্থাৎ, কর্মসংস্থানের পরিমাণ ১ শতাংশ বাড়াইবার জন্য আর্থিক বৃদ্ধির হার নিদেনপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। কম হউক বা বেশি, ভারতে সব জমানাতেই আর্থিক বৃদ্ধি হইয়াছে। কিন্তু, কর্মসংস্থানের অঙ্কে তাহার প্রতিফলন ক্রমে ক্ষীণতর হইয়াছে। বর্তমান জমানায় অবস্থা সর্বাপেক্ষা মারাত্মক। অর্থনীতির কোনও প্রশ্ন যদি সত্যই ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে, তবে তাহা এই ‘কর্মসংস্থানহীন আর্থিক বৃদ্ধি’। জিডিপির বৃদ্ধির হার কোন সিরিজ়ে কেমন দাঁড়াইল, বিরোধী রাজনীতি যদি তাহাতেই ব্যস্ত হইয়া পড়ে, শাসকদের ন্যায় খুশি আর কেহ হইবে না।

কারণ, সেই প্রশ্নে চাপানউতোর চালাইয়া যাওয়া সহজ। কর্মসংস্থানের ছবিটি এমন করুণ কেন, এই প্রশ্নের উত্তর নরেন্দ্র মোদীদের নিকট নাই। আর্থিক বৃদ্ধির হার, রামমন্দির বা রাহুল গাঁধীর গোত্র নহে, ২০১৯-এর নির্বাচনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হওয়া উচিত কর্মসংস্থান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE