সংখ্যা বস্তুটি গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারে, কিন্তু তাহাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বস্তু নহে। তর্কশাস্ত্রের এই শিক্ষাটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের নিকট অত্যন্ত জরুরি হইয়া উঠিল। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ফল হইতে সংখ্যা যেমনই পাওয়া যাউক না কেন, একটি বিষয় প্রকট। ভারতীয় জনমনে ভারতীয় জনতা পার্টির পরাজয় ঘটিতেছে। কংগ্রেস হৃত অবস্থান পুনরুদ্ধার করিতেছে। বার্তাটি পড়িবার জন্য ছত্তীসগঢ়ের ফলাফল আঁকড়াইয়া ধরিবার দরকার নাই, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের দিকে তাকাইলেও চলে। ঠিকই, রাজস্থানে বিশেষজ্ঞরা যেমনটি বলিতেছিলেন, কংগ্রেস সে ভাবে ‘সুইপ’ করিতে পারে নাই। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির উপর্যুপরি তিন বারের শাসনমেয়াদের স্বাভাবিক অবস্থানগত অসুবিধার সুযোগ লইয়া কংগ্রেস বিপুল গরিমায় উদ্ভাসিত হইতে পারে নাই। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও বার্তাটি মিথ্যা হইয়া যায় না, কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের আনন্দোচ্ছলতা অর্থহীনতায় পর্যবসিত হইয়া যায় না। দেশের মধ্যভাগের তিন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের যত মানুষ এই বারের ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিলেন, যতগুলি আসন শাসক দলকে খোয়াইতে বাধ্য করিলেন, তাহাতে কেবল রাজ্য বিজেপির দফতরগুলিতে নহে, দিল্লির শাসকমহলেও ঘোর উদ্বেগ-মেঘ ঘনাইবার কথা। কোনও ভবিষ্যৎচর্চায় না গিয়া কেবল বর্তমান-চর্চার ভিত্তিতেই এখন বলা সম্ভব, ২০১৯ বৎসরটি নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে সহজ ও মোলায়েম হইবে না।
তবে কি নরেন্দ্র মোদী নামক ম্যাজিকটি এই বার কাজ করিল না? সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির জয়কে বারংবার মোদী ম্যাজিক দিয়া ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। সেই ক্ষেত্রে বিজেপির পরাজয়কেও কি মোদী ম্যাজিকের অভাব দিয়াই ব্যাখ্যা করা উচিত নহে? উত্তরটি একাক্ষরে দিবার মতো সহজ নহে। স্থিতাবস্থা-বিরোধিতা, না কি মোদী ম্যাজিকের অনুপস্থিতি, কোন হাওয়াটি বেশি জোরালো, তাহা বুঝিতে গেলে স্মরণে রাখা কর্তব্য: এই বারের নির্বাচনে কিন্তু বিজেপির পোস্টারে বা বিজ্ঞাপনে মোদীর মুখটি অন্যান্য বারের তুলনায় ঈষৎ ছোট আকারেই দেখা গিয়াছে। একাধিক রাজ্যে নির্বাচনী জনসভাতেও মোদীর উপস্থিতি তুলনায় কম ছিল। অর্থাৎ সম্ভবত নেতৃবরের ম্যাজিকের ক্ষীণতা লইয়া তাঁহার দল আগে হইতেই কিছুটা সতর্ক ছিল। এবং সেই কারণে স্থানীয় বিষয়গুলি নির্বাচনে উঠিয়া আসিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। আবার, সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ঠিক যে, কেবল প্রাদেশিক প্রশাসনের দিকে তাকাইলে বলিতে হয়, স্থিতাবস্থাবিরোধী হাওয়া যতটা জোরে বহিবার কথা, ততটা হয়তো বহে নাই। রমন সিংহ কিংবা শিবরাজ সিংহ চৌহান পরিশ্রমী মুখ্যমন্ত্রী, ইহা তাঁহাদের বিরোধীরাও স্বীকার করিবেন। সাম্প্রতিক কালে তাঁহাদের রাজ্যে গ্রামীণ কৃষিসমাজ কিংবা শহুরে বণিকসমাজের ক্ষোভের কারণ প্রাদেশিক নীতি নহে, কেন্দ্রীয় নীতিসমূহ— অর্থাৎ কৃষিঋণভার, নোটবন্দি কিংবা জিএসটি।
রাহুল গাঁধীর উল্লেখ ছাড়া এই বারের নির্বাচনী চিত্রাঙ্কন সম্পূর্ণ হইতে পারে না। প্রায় ধুলা হইতে কংগ্রেস সংগঠনকে তুলিয়া দাঁড় করাইবার কৃতিত্ব কংগ্রেস সভাপতিরই প্রাপ্য। তিনি বিপরীতে ছিলেন বলিয়াই বিজেপির রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবটি অধিক ভাবে অনুভূত হইয়াছে। বিজেপি যখন উদ্ভ্রান্ত হিন্দুত্বের টানে ভাসিয়া যাইতেছে, গরুর গায়ে রং মাখাইয়া নির্বাচনী প্রচার সারিতেছে, তখন কংগ্রেস প্রচারকে যে বাস্তবমনস্ক লাগিতেছিল, তাহার পিছনে উচ্চ নেতৃত্বের অবদান অনেকখানি। তবে কিনা, ভোটের ফলাফলের আনন্দবিষাদের প্রাথমিক ধাক্কাটি কাটিয়া যাইবার পর অচিরে কংগ্রেস ও বিজেপি নেতারা নিজ নিজ পরিসরে যে শব্দটি লইয়া প্রবল এবং গভীর দুশ্চিন্তা করিতে বসিবেন, তাহার নাম: শরিক। ২০১৯ সালে সম্ভবত আর সব ছাপাইয়া জাদুকাঠি হইতে চলিয়াছে এই শব্দটিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy