দীনদয়াল মার্গের সামনে আক্রান্ত স্বামী অগ্নিবেশ। ছবি: সংগৃহীত।
শেষটা ভাল হলেই সবটা ভাল। এমনটা প্রবাদে বলা হয়। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ক্ষেত্রে শুধু শেষটা নয়, প্রায় সবটাই অথবা অধিকাংশটাই ভাল ছিল। কিন্তু শেষটা যেন আর নিটোল রইল না।
দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রয়াণ ঘটেছে। শুধু শেষটা নয়, তাঁর গোটা রাজনৈতিক জীবনটাই চর্চিত হচ্ছে প্রয়াণের পরে। গোটা রাজনৈতিক জীবনটাই প্রশংসিত হচ্ছে দেশজুড়ে। এই রকম এক ব্যক্তিত্বের শেষযাত্রায় সামিল হওয়ার জন্য হাজির হয়েছিলেন হাজারে হাজারে। সামিল হয়েছিলেন বা হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন স্বামী অগ্নিবেশও। সে চেষ্টা বিফলে গেল। স্বামী অগ্নিবেশকে আবার প্রহৃত হতে হল। প্রহৃত হতে হল শেষকৃত্য স্থলের অদূরেই।
অটলবিহারী বাজপেয়ী কোনও দিনই অগ্নিবর্ষী রাজনীতিক ছিলেন না। অসামান্য ব্যক্তিত্ব, অসমান্তরাল বাগ্মিতা, উদার হৃদয়, সবার নেতা হয়ে ওঠার ক্ষমতা বাজপেয়ীকে বাজপেয়ী বানিয়েছিল। যে দলে বা যে সব সংগঠনে আজীবন ছিলেন বাজপেয়ী, সেই সব সংগঠনে তীব্র কট্টরবাদী কণ্ঠস্বরের অভাব ছিল না। কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ী সকলের মধ্যে থেকেও সকলের চেয়ে আলাদা ছিলেন। দীর্ঘ সংসদীয় যাত্রাপথের কারণে এবং সর্বোচ্চ স্তরের জোট রাজনীতি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করার সুবাদে অটলবিহারী বাজপেয়ী বরেণ্য রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক নীতিতে ভেদাভেদের কোনও স্থান ছিল না। তাঁর দরবারে কোনও ভারতবাসীর যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু শেষটা ভাল হল না। সবার নেতা, সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হিসেবে জীবদ্দশাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন যিনি, তাঁর অন্তিমযাত্রায় সামিল হওয়ায় দরজা সবার জন্য খুলে দেওয়া গেল না। অটলিহারী বাজপেয়ীর মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার সময়ে আক্রান্ত হলেন বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রখ্যাত কর্মী স্বামী অগ্নিবেশ। প্রকাশ্যেই শারীরিক হেনস্থার মুখে পড়তে হল তাঁকে। পুলিশি হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পেলেন। কিন্তু প্রায় গোটা দেশের প্রতিনিধিত্ব যখন ঘিরে রইল বাজপেয়ীর মরদেহকে, তখন অগ্নিবেশের আক্রাম্ত হওয়ার ঘটনা কিছুটা কালিমালিপ্তই করল পরিস্থিতিকে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
অটলবিহারী বাজপেয়ী নিজে ধর্মমত বা জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করতেন। করতেন বলেই অন্ত্যেষ্টিতেও পাশে পেলেন সমগ্র ভারতকে। কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ী যে ভারতীয় রাজনীতির হিন্দুত্ববাদী ধারার অংশ ছিলেন এবং তাঁকে ঘিরে যে কট্টরবাদীদের নিরন্তর উল্লাস ছিল, তাও অস্বীকার করা যায় না। গোটা রাজনৈতিক জীবনেই এই বৈপরীত্য অটলের সঙ্গী ছিল। মৃত্যুতেও সে বৈপরীত্য অটলকে ছাড়ল না। উগ্রতার উপাসকরা তাঁর অন্ত্যেষ্টিস্থলেও হাজির ছিলেন। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের উগ্র মতাদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী অগ্নিবেশকে হেনস্থা করলেন তাঁরাই।
আরও পড়ুন: অটলকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আক্রান্ত অগ্নিবেশ
দেশ এক অদ্ভূত সময়ের মুখোমুখি। শাসকদল তথা দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা অসহিষ্ণুতায় অভিযুক্ত আজ। বাজপেয়ীও এই দলে থেকেই দেশকে শাসন করেছিলেন। কিন্তু অসহিষ্ণুতায় অভিযুক্ত হননি কখনও। সবাইকে নিয়ে চলতে পারাই বরং বাজপেয়ীর সবচেয়ে চর্চিত গুণ ছিল। প্রয়াণের পরেও বাজপেয়ীর সেই গুণই সবচেয়ে বেশি করে আলোচিত হচ্ছে। কারণ, অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো সহিষ্ণু এবং সর্বাত্মক নেতারই অভাব আজ বোধ করছে দেশ। কিন্তু এই বাজপেয়ীকেও শুরু থেকেই ঘিরেছিলেন কট্টরবাদীরা। তাঁদের সামলেই রাজনীতি করতে হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রয়াণের পরে যখন দৃষ্টান্তমূলক নেতৃত্বের জন্য স্মরণ করা হচ্ছে বাজপেয়ীকে, তখনও রাজনৈতিক উগ্রবাদ পিছু ছাড়ল না। কট্টরবাদীদের হাতে নিগৃহীত হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা স্বামী অগ্নিবেশ।
স্বামী অগ্নিবেশ অটলবিহারী বাজপেয়ীর নশ্বর দেহে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন। যাঁরা তাঁকে হেনস্থা করলেন, তাঁরাও বাজপেয়ীর অন্তিম যাত্রাতেই সামিল হয়েছিলেন। হেনস্থাকারীরা কি আদৌ গৌরবান্বিত করলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর শেষযাত্রাকে? নাকি কালি ছিটিয়ে দিলেন খানিকটা? সবার নেতা, সহিষ্ণু নেতা, সব অংশের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে বাজপেয়ীকে। ঠিক সে সময়েই অগ্নিবেশের হেনস্থাকারীরা যেন দেখিয়ে দিলেন, বাজপেয়ীও অনেক ক্ষেত্রেই অসহায় ছিলেন নিজের দলের কট্টরবাদীদের সামনে। অন্তিম যাত্রাতেও কট্টরবাদীরা প্রমাণ দিলেন যে, তাঁরা বাজপেয়ীকে ঘিরেই রয়েছেন। এই প্রমানটা না দিলেও বোধহয় চলত। মহান রাষ্ট্রনেতার শেষ যাত্রাটা তাতে আরও বেশি গৌরবান্বিত হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy