বালি দ্বীপটা একটা আস্ত সংগ্রহশালা। গুরা রাই বিমানবন্দর থেকে যত দ্বীপের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, তত চোখে পড়ে সেই সংগ্রহ: রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়ে থাকা মূর্তি, কারুকার্য, ভাস্কর্য। কোনওটা মোড়ের মাথায় বসানো, কোনওটা রাস্তার ধারে অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে। অর্জুন-গণেশ থেকে নকুল-সহদেব, কে নেই সেখানে!
জনসংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া। ২৬ কোটির কিছু বেশি মানুষের দেশে সাড়ে ২২ কোটি মুসলমান। সেখানে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর স্বর্গরাজ্য! চমক বাড়ল গাড়ির চালক কাদেক আর্সিকা-র প্রশ্নে, ‘‘আপনারা পর্ক খান?’’ উত্তর দেওয়ার আগেই হাইওয়ের ধারে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এই দেখুন, একটা পিগারি।’’ বালিনিজ় পর্কের পদের কথা কলকাতায় শুনেছি। কিন্তু বালির মাটিতে তা এত সহজলভ্য, ভাবতে পারিনি। তবে সেটা যে চিন্তাশক্তির দুর্বলতা, সে কথা বছরখানেকের পুরনো একটা খবর ঝালিয়ে নিলেই বোঝা যাবে। সৌদি আরবের রাজা সলমন যখন বালি সফরের কথা ঘোষণা করেন, ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানের সৌজন্যে ‘সংগ্রহশালা’ ঢেকে দেওয়ার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দৃঢ় ভাবে ভিন্ন মত ঘোষণা করেন বালির গভর্নর ই মাদে মাঙ্কু পাস্তিকা। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়ে দেয়, তাদের পথেঘাটে সাজানো মূর্তিগুলি যেমন আছে, থাকবে ঠিক তেমনই। কারণ ওগুলো বালির সংস্কৃতি। বক্তব্যটি স্পষ্ট: সহিষ্ণুতার জন্যই বালির খ্যাতি।
বালির জোরের জায়গাটা বুঝতে একটা তুলনা দরকার প্রতিবেশী দ্বীপ জাভার সঙ্গে। সেখানেও গিয়েছিলেন সলমন। দ্বীপরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন পশ্চিম জাভা প্রদেশের বোগোর শহরে। সেখানে প্রাচীন জাভা-সংস্কৃতির প্রভাবে প্রচুর নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারী-পুরুষের মূর্তি। কিন্তু বালির সাহস সেখানে নেই। অতএব সে সব ঢাকা পড়েছিল সাদা কাপড়ে। আর যে সব সিংহ কিংবা ড্রাগনের জন্য কাপড় বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি, তাদের সম্বল ছিল গাছের আড়াল!
মনে পড়ল আরও কয়েকটি ব্যাপার। প্রথম, এক মহিলা কবির বয়ান: ‘‘আমি ইসলামি শরিয়া জানি না, শুধু জানি ইন্দোনেশিয়া মায়ের খোঁপা অপরূপ, মুখের ওই আবরণের চেয়ে।/ আমি ইসলামি শরিয়া জানি না, শুধু জানি ইন্দোনেশিয়া মায়ের সঙ্গীত বড় মধুর, ওই আজানের চেয়ে।’’ কবির নাম সুকমাবতী সুকর্ণপুত্রী। ব্যক্তিপরিচয়ে স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ-র কন্যা। ধর্মপরিচয়ে মুসলমান। রেহাই মেলেনি তাঁর। ‘জিহাদ’-এর ডাক দেন উগ্রপন্থীরা। ‘সমস্যা’ মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন নরমপন্থীরা। অবশেষে ক্ষমা চেয়ে নেন ‘ইবু ইন্দোনেশিয়া’ (ইন্দোনেশিয়া মাতা)-র রচয়িতা।
দ্বিতীয়, জাকার্তার গভর্নর তখন বাসুকি ত্যাহাজা পুর্নামা। ধর্মে খ্রিস্টান। আচমকা তাঁর মন্তব্য: যদি কোরানের দোহাই দিয়ে বোঝানো হয় যে কোনও অমুসলমানকে ভোট দিতে পারবেন না মুসলমানেরা, সেটা প্রতারণা। অতঃপর ধর্মদ্রোহের অভিযোগ। আদালতের নির্দেশে কারাবাস।
তৃতীয়, রবিবার সকালে প্রার্থনার জন্য জড়ো হয়েছেন সকলে, ১০ মিনিটের ব্যবধানে সুরাবায়া শহরের তিনটি গির্জা কেঁপে উঠল আত্মঘাতী বিস্ফোরণে। হতাহত মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫০ ছাড়ায়। প্রশাসন জানায়, ঘটনার পিছনে হাত রয়েছে তিন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের।
বিপরীত ছবিও চোখে পড়ে। বরোবুদুর মন্দিরের বাইরে ফল বিক্রি করছিলেন হিজাব পরিহিত এক মাঝবয়সি মহিলা। হঠাৎ টান মেরে হিজাবটি মাথা থেকে খুলে ফেলে ঘাম মুছলেন। খানিক হাওয়া খেলেন। ফের চাপিয়ে নিলেন মাথার কাপড়। আবার, জাকার্তার অভিজাত রেস্তরাঁয় ভদকা পরিবেশন করছিলেন হিজাব পরিহিত তরুণী।
বহুমতকে ধারণের জোর সংখ্যাগুরুকে দিতে পারেন সংখ্যালঘুরাই। এলাকা হিসেবে বালি যৎসামান্য। ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যায় মাপলে এক শতাংশেরও কম। তবুও, বালিই প্রায় নির্ধারণ করে ইন্দোনেশিয়ার ভিসা নীতি। স্বাভাবিক, কারণ গত বছর মার্চে এক নামী বেসরকারি পর্যটন সংস্থার সমীক্ষা জানিয়েছিল, পর্যটকদের নির্বাচনে বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে বালি। ইন্দোনেশিয়ায় বেড়াতে গেলে ভারত-সহ ১৪০টা দেশের নাগরিকের এক মাস কোনও ভিসা লাগে না। পাসপোর্টে ‘ভিসা এগজ়েমশন স্ট্যাম্প’ দেওয়া হয়, ব্যস। পর্যটনে উৎসাহ দিতেই এই ব্যবস্থা। অর্থনীতিতে ছাপ রেখে হিন্দুপ্রধান বালি পথ দেখিয়েছে মুসলিমপ্রধান ইন্দোনেশিয়াকে। চালিকা শক্তি হয়ে শিরদাঁড়া টানটান রেখেছে পুঁচকে দ্বীপ।
‘জাভাযাত্রীর পত্র’-এর ৯ নম্বর চিঠিটা বালির কারেম আসন-এ বসে প্রতিমা দেবীকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিঠির শেষে অতীত-বর্তমান দ্বন্দ্ব নিয়ে একটা ছোট কবিতা ছিল: ‘‘আমার সঙ্গে লড়াই করে কখ্খনো কি পার/ বারে বারেই হার।’’/ আমি বললেম, ‘‘তাই বৈকি! মিথ্যে তোমার বড়াই,/ হোক দেখি তো লড়াই।’’
কাশ্মীর-ভারত সম্পর্কটা এমন হতে পারে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy