Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শৌচাগার দিবস—কোনও অচ্ছুতকথা নয়

যে দেশে (ভারতবর্ষ) বছরে এক লক্ষেরও বেশি শিশুমৃত্যুর কারণ শুধু অস্বাস্থ্যকর পয়ঃপ্রণালী, আর যে গ্রহে এখনও সাড়ে চারশো কোটি মানুষের শৌচাগার নেই, সেখানে অনেক জরুরি একটি ‘শৌচাগার দিবস’। লিখছেন শর্মিষ্ঠা দাসবুক ঠুকে বলুন তো, আপৎকালীন প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময় হাতের নাগালে শৌচালয় নেই—কে জীবনে, এমন সঙ্কটের মুখোমুখি হননি?

শৌচালয় তৈরি করছেন মহিলারাই। ফাইল ছবি

শৌচালয় তৈরি করছেন মহিলারাই। ফাইল ছবি

শর্মিষ্ঠা দাস
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৮ ০২:০৩
Share: Save:

গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়ে? রাজার পুত্রলাভের খবরে তিনি কতটা প্রীত হয়েছেন? গোপালের দাবি ছিল, প্রবল বেগ এলে, বড় প্রাকৃতিক কাজটি সেরে যেমন ফুরফুরে লাগে ঠিক তেমনই! গল্পটি যতটা না মোটা দাগের হাস্য রসের খোরাক তার চেয়ে অনেক বেশি এক বাস্তব সমস্যার প্রতিফলন।

বুক ঠুকে বলুন তো, আপৎকালীন প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময় হাতের নাগালে শৌচালয় নেই—কে জীবনে, এমন সঙ্কটের মুখোমুখি হননি?

সুতরাং ‘বিশ্ব শৌচালয় দিবস’ কথাটা শুনেই ‘ছি ছি’ বলে কানে আঙুল দেওয়ার কোনও কারণ দেখি না। যে দেশে (ভারতবর্ষ), বছরে এক লক্ষেরও বেশি শিশুমৃত্যুর কারণ শুধু অস্বাস্থ্যকর পয়ঃপ্রণালী, আর যে গ্রহে এখনও সাড়ে চারশো কোটি মানুষের শৌচাগার নেই, সেখানে অনেক জরুরি একটি ‘শৌচাগার দিবস’।

২০০১ সালে জ্যাক সিম নামে সিঙ্গাপুরের মানবপ্রেমী মানুষটি প্রথম তাঁর ‘বিশ্ব শৌচাগার সংস্থা’-র (World Toilet Organisation) তরফ থেকে ১৯ নভেম্বর দিনটিকে ‘বিশ্ব শৌচাগার দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়। তারও আগে ২০১০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘নিরাপদ জল ও পয়ঃনিষ্কাশন’কে মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত করেছে।

কিন্তু ‘অধিকার’ বললেই হল না। ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়েও বিশ্বের ৮৯.২ কোটি মানুষ খোলা আকাশের নীচে মলত্যাগ করেন বা করতে বাধ্য হন! মুক্ত প্রকৃতিতে মলত্যাগের (Open air defaecation) সঙ্গে জড়িত শুধু দৃশ্যদূষণ, বায়ুদূষণ বা দুর্গন্ধ নয়, পারিপার্শ্বিক অনেকটা পরিধি জুড়ে মাটি ও জলদূষণও বটে।

মলের সঙ্গে যে সব রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু মাটিতে মেশে, সে সব জীবাণু, পরজীবী, কৃমিদের ডিম অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন জীবিত থাকে ও মাটি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ জল—যথা কুয়ো, নলকূপ ও ভূমিস্তরের পুকুর, নদী, নালায় মিশে জলদূষণের কারণ হয়ে ওঠে। নাগালের মধ্যে উন্মুক্ত ‘মনুষ্য বিষ্ঠা’ থাকলে, কীটপতঙ্গের দ্বারাও খাবার ও জলে জীবাণু সংক্রমণ ঘটে।

উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগের অভ্যাস পরিবেশে যে যে রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার তালিকাটি বেশ দীর্ঘ—ভাইরাল হেপাটাইটিস এ এবং ই, শিশুদের রোটা ভাইরাস জনিত ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, নানা রকম ব্যাকটিরিয়াজাত আন্ত্রিক, আমাশয়াদি, বিভিন্ন রকমের কৃমি, ‘সিস্টোসোমিয়াসিস’ ইত্যাদি। এ সব অসুখ শুধু যে জলবাহিত রোগের মৃত্যুহার এ সংখ্যা যোগ করে তা-ই নয়, অপুষ্টি, রক্তাল্পতা, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিরোধ—আনুষঙ্গিক, সমান্তরাল ক্ষতি করেই চলে। সে স্বাস্থ্যহানি প্রতিফলিত হয় আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে।

সুতরাং দুনিয়াকে নড়েচড়ে বসতে হল। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘টেঁকসই উন্নয়ন প্রকল্প-৬’ (Sustainable Development Goal 6 বা এসডিজি ৬) এর লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষের জন্য নিরাপদ শৌচাগার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রণয়ন, ‘খোলা জায়গায় মলত্যাগ মুক্ত’ পৃথিবী। এ বছর শৌচালয় দিবসের থিম—‘প্রকৃতি যখন ডাকে’, অর্থাৎ, পরিবেশ বান্ধব উপায়ে কী ভাবে প্রকৃতির ডাকে মানুষ সাড়া দেবে তা নিয়ে আলোচনা, সচেতনতার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছনো এবং শৌচাগার নির্মাণ।

শৌচাগারের ট্যাঙ্কের দেয়াল যেন যথেষ্ট মজবুত হয় আর অবশ্যই পরস্পর সংযুক্ত দু’টি ‘সেফটি ট্যাঙ্ক’ থাকে—যাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ‘মল’ প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত হয়ে জমির সার হিসেবে কাজে লাগবে। জলের অপব্যবহার বন্ধ করা, বর্জ্য জলকে পুনঃব্যবহারের জন্য পরিশোধিত করা, শৌচকর্মের পরে ভাল ভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা প্রচার ইত্যাদি বিষয়ও এই প্রকল্পটির অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্বের মোট যে সংখ্যক মানুষ শৌচাগার ব্যবহার করেন না, তাঁদের শতকরা ৫৯ ভাগ ভারতের লোক। স্বাভাবিক ভাবেই এসডিজি-৬ এর কাজের পরিসর সবচেয়ে বেশি ভারতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ‘ইউনিসেফ’ও এসডিজি ৬-এর সফল রূপায়ণে সাহায্য করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান, জাতীয় প্রকল্প কাজ শুরু করেছে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর থেকে। এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা—২০১৯ সালের ২ অক্টোবরের মধ্যে গরিব মানুষের জন্য ৯ কোটি শৌচাগার তৈরি করা—যাতে এক জনও খোলা জায়গায় মলত্যাগ না করে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৮.৬ কোটি শৌচাগার নির্মাণ হয়েছে। খোলা জায়গায় মলত্যাগকারী মানুষের সংখ্যা ৫৫ কোটি থেকে কমিয়ে ১০ লক্ষে আনা গিয়েছে।

কপালের ভাঁজটা তবু পুরোপুরি যেতে চায় না। আমাদের মত‌ো উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্প ভাবনা আর সার্থক ভাবে তার বাস্তবায়নের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়। নদীর কাছে নিয়ে গেলেই যে কেউ জল খাবে তা নিশ্চিত নয়। সচেতনতা, আরও বাড়ানো পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরির একমাত্র পথ। না হলে শৌচাগারের দোরগোড়ায়, উদ্বোধনের গাঁদাফুলের মালা পড়ে থেকে শুকোবে। কিন্তু শৌচাগারের যথার্থ ব্যবহার হবে না।

প্রতি মাথাপিছু গার্হস্থ্য শৌচাগার নিয়ে যেমন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, ঠিক ততটাই প্রয়োজন কর্মস্থলে, পথে-ঘাটে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে ‘কমিউনিটি টয়লেট’। ১৯৭০ সালে বিহারের বিন্দেশ্বর পাঠক এই প্রয়োজন অনুভব করে ‘সুলভ শৌচালয়’ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সামান্য মূল্যে সুলভ শৌচালয় ব্যবহার করা যায়। দুটি ট্যাঙ্ক যুক্ত শৌচালয়ের ক্ষেত্রে যে ট্যাঙ্ক সাফাই করাতে হয় না, উপরন্তু বিনিপয়সায় সার পাওয়া যায়—এই ধারণাটির জনক ‘সুলভ’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

দেশ জুড়ে ৮,৫০০ সুলভ শৌচালয় কমপ্লেক্স রয়েছে। তবু সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। ব্যস্ত আধুনিক জীবনের চাহিদা অনুযায়ী মানুষকে এখন বাড়ির বাইরেই অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়। তখন হাতের নাগালে পরিচ্ছন্ন শৌচালয় মিলবে তো? গ্রামের ‘খোলা জায়গায় শৌচকর্ম’ আর শহরের ওই কাজের কারণ ও চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখনও শহরে শতকরা ১২ ভাগ খোলা জায়গায় মলত্যাগ ও শৌচকর্ম হয়, যা যতটা না অভ্যাসবশে, তার চেয়ে অনেক বেশি বাধ্য হয়ে। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট অথবা টয়লেটের অভাবের কারণে কর্মরত মহিলাদের একটা বড় অংশ এখনও সারাদিন জল না খেয়ে কাটান। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহারের ফলে মূত্রঘটিত সংক্রমণ রোগ মহিলাদের খুব বেশি দেখা যায়। উন্নত দেশে পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে দেবালয় আর শৌচালয়ে ফারাক থাকে না। আমাদের মতো জনবহুল দেশে সচেতনতা আরও বেশি জরুরি।

‘বিশ্ব শৌচালয় দিবস’ আসলে এক ‘অচ্ছুতকথা’ থেকে আলোকময় সুস্থজীবনে উত্তরণের গল্প।

লেখক দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE