—ছবি এপি।
ধর্মের মধ্য দিয়া লিঙ্গবিভাজনের রসায়ন কেমন ভাবে তীব্র করিয়া তুলিতে হয়, তাহার হাতে-গরম দৃষ্টান্ত দিয়া চলিয়াছে দুই হাজার আঠারোর ভারত। কেরলে শবরীমালা মন্দিরে নারীরা পুরুষের মতোই অবাধে প্রবেশ করিতে পারেন, এমন একটি সহজিয়া কথাও তাই সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারকদের মুখ হইতেই ধ্বনিত হইতে হইল। এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় বাহির হইবার পরও অবাধে সেই রায় অগ্রাহ্য করিয়া শবরীমালা মন্দির-পথে নারী ভক্তদের আটকাইবার অসামান্য সব ব্যবস্থা হইল, রাজনৈতিক দলগুলি খোলাখুলি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারের বিপরীতে গিয়া মানুষ খেপাইবার যজ্ঞে নামিল, দুই সপ্তাহ ধরিয়া মন্দিরের চারিপাশে প্রায় যুদ্ধক্ষেত্র রচনা হইল, প্রশাসনের সহিত রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক নেতাদের খণ্ডযুদ্ধের মাঝে হাজারে হাজারে গ্রেফতার হইলেন। যে বিষয়ে মামলার রায় ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ আদালত ঘুরিয়া আসিয়াছে, বিচারকদের বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চ যাহার মীমাংসা করিয়াছে, তাহা লইয়া আবারও সার্ধসহস্রাধিক মামলা দায়ের হইয়াছে! লক্ষণীয়, বিজেপি হইতে কংগ্রেস, দুই বৃহৎ দলই কিন্তু মন্দিরে নারীপ্রবেশ আটকাইতে দ্বিধান্বিত নয়। বিজেপির রাজ্য সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ— তিনি ঘোষণা করিয়াছেন যে, পুরোহিতবর্গের অনুমোদনক্রমে তাঁহাদের সিদ্ধান্ত, মন্দিরে মহিলারা প্রবেশের চেষ্টা করিলে মন্দিরের সব দরজা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে। দেশের আইন বা বিচার কোনওটিকেই যে এই নেতারা পাত্তা দেন না, এবং পাত্তা না দিবার বার্তা নির্ভয়ে ছড়াইয়া থাকেন, শবরীমালা কাহিনি তাহার নয়া প্রমাণ হিসাবে ভারত-ইতিহাসে জ্বলজ্বল করিবে। আইনের শাসন কথাটিই অপ্রাসঙ্গিক করিয়া এত বড় দেশের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বটিকেই বিপন্ন করিয়া দিবার কৃতিত্ব এই নেতারা দাবি করিতে পারেন।
এই পরিবেশে কেহ কোনও স্বাভাবিক কথা বলিলেও তাহা যেন অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বিকিরণ করিতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে কালীপূজার প্রাক্কালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি তাই বিশেষ আশ্বাসদায়ক শুনাইল। তিনি বলিয়াছেন, পূজায় কোনও মহিলাপুরুষ ভেদাভেদ থাকিতে পারে না, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও নয়। ধর্মাধর্মনির্বিশেষে নারীপুরুষের মধ্যে বৈষম্য চলিবে না, ইহাই গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানসম্মত অধিকার। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ নাগরিকের অধিকার সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বাস্তবে বিভিন্ন উপলক্ষে সেই অধিকার লঙ্ঘিত হইলেও নীতি হিসাবে তাহার মর্যাদা লইয়া প্রশ্ন উঠিত না। অধুনা উঠিতেছে। কেবল প্রশ্ন নহে, রাজনীতির কল্যাণে মানুষ ও তাহার অধিকারের মাঝখানের জমিটিতে আসিয়া অভেদ্যরূপে দাঁড়াইতেছে ‘ভাবাবেগ’ নামক একটি অমিতপ্রতাপ বস্তু। তাহার দোহাই দিয়া অধিকারের যথেচ্ছ ছাঁটাই চলিতেছে, কেননা কোনও এক অবোধ্য যুক্তিতে দাবি করা হইতেছে— ভাবাবেগের অধিকার নাকি ব্যক্তি-অধিকারের অপেক্ষা বড়!
সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ঠিক এই জায়গাটিতেই আলোক ফেলিতে চাহিয়াছিল, যে কোনও যৌথ বা সামাজিক নৈতিকতা যে সাংবিধানিক নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না, তাহাই স্পষ্ট করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু, স্পষ্টতই, ধর্ম লইয়া যাঁহারা রাজনীতি করেন তাঁহাদের কাছে ঠিক এই পরিসরটিই অত্যন্ত গুরুতর, আদালতের রায় মানিয়া ছাড়িয়া দিবার সুস্থ শুভবুদ্ধি রাখিলে তাঁহাদের চলে না। সাংবিধানিক নৈতিকতাকে এই সব যৌথ ভাবাবেগের অপেক্ষা অনেক ছোট, বস্তুত নগণ্য করিয়া না দেখাইলে তাঁহারা কী রামমন্দির কী শবরীমালা মন্দির, কোনও ক্ষেত্রেই দন্তস্ফুট করিতে পারিবেন না। সেই দিক দিয়া দেখিলে, শবরীমালা অধ্যায় ভারতের অন্ধকার বর্তমানের— এবং বিপন্ন ভবিষ্যতের— একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy