Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নোটবন্দি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

কালো টাকা পূর্ববৎ

আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: সরকারি নীতি অনেক ভাবেই ব্যর্থ হতে পারে। নীতি হিসেবে চমৎকার, কিন্তু রূপায়ণ করতে গিয়ে কেলেঙ্কারির একশেষ হয়েছে, এমন বহু নীতি আছে। লিখছেন মৈত্রীশ ঘটক

দীর্ঘ লাইন ব্যাঙ্কের সামনে। হয়রানি সাধারণ মানৃুষের। —ফাইল চিত্র।

দীর্ঘ লাইন ব্যাঙ্কের সামনে। হয়রানি সাধারণ মানৃুষের। —ফাইল চিত্র।

মৈত্রীশ ঘটক
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সরকারি নীতি অনেক ভাবেই ব্যর্থ হতে পারে। নীতি হিসেবে চমৎকার, কিন্তু রূপায়ণ করতে গিয়ে কেলেঙ্কারির একশেষ হয়েছে, এমন বহু নীতি আছে। আবার, দারুণ রূপায়ণ হল, কিন্তু নীতিটার মধ্যে ভাবনাচিন্তার ছাপমাত্র নেই, এমন পরিকল্পনাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু, এই দুই গোত্রের ব্যর্থতার চেয়েও মারাত্মক ব্যর্থতা সম্ভব— যেখানে নীতিও ভ্রান্ত, আর তার রূপায়ণও ততোধিক খারাপ। এই রকম ক্ষেত্রে নীতি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হয় তো বটেই, পাশাপাশি আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটতে থাকে। কারণ, সব কিছুই তখন অনিশ্চিত, সব কিছুই এলোমেলো। নরেন্দ্র মোদীর ডিমনিটাইজেশনের নীতিটা এই গোত্রের। নীতি হিসেবেও ভুল, রূপায়ণও ভয়ানক।

নরেন্দ্র মোদী যে কামানটি দাগলেন, তাতে লাভ বড় জোর এককালীন— নগদ হিসেবে যে কালো টাকা বিভিন্ন লোকের হাতে (অথবা, সিন্দুকে, তোষকের নীচে, দেওয়ালের ভিতর, যেখানে ভাবতে ইচ্ছে করে, সেখানেই) রয়েছে, মোদীর কামানের গোলায় এই দফায় সেগুলো নষ্ট হল। কিন্তু, সে তো অর্থ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ীই দেশের মোট অঘোষিত আয়ের পাঁচ-ছয় শতাংশ মাত্র। কাজেই, যদি ডিমনিটাইজেশনের সুফল বলতে শুধু এটুকুই হয়, তবে এই মুহূর্তে দেশের মোট কালো অর্থনীতি ধ্বংসের কাজেও নরেন্দ্র মোদীর গোলাটি তেমন কার্যকর নয়। তার ওপর, কালো টাকা তৈরি তো থেমে থাকবে না। ডিমনিটাইজেশন দিয়ে কর ফাঁকি দেওয়াও ঠেকানো যাবে না, দুর্নীতিতেও রাশ টানা যাবে না, অপরাধেও নয়। পুরনো নোটে যেমন চলত, নতুন নোটেও এগুলো তেমনই চলবে। সত্যি বলতে, নতুন নোটের কল্যাণে নগদ কালো টাকার পরিমাণ বা়ড়তেও পারে। হাজার টাকার বদলে ২০০০ টাকার নোটে রাখলে টাকা রাখতে অনেক কম জায়গা লাগবে কিনা! এবং, বে-আইনি টাকা মজুত করার হরেক ফিকির খুব দ্রুত আবিষ্কৃত হয়ে যাবে বলেই অনুমান।

এই নীতির ‘ব্যয়’ কতখানি, সেই হিসেবটাও পাশাপাশি কষে রাখা ভাল। নতুন নোট ছাপাতে মোট ১২,০০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। সেটা বাদ দিলেও, ডিমনিটাইজেশনের ধাক্কা বিপুল। ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময় মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ দেশের টাকার জোগান ৩০% কমিয়ে দিয়েছিল। তাতে ফেড-এর বিপুল সমালোচনা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী তুলে নিয়েছেন ভারতের মোট নোটের ৮৬ শতাংশ।

মহামন্দার সময়কার আমেরিকার তুলনায় নগদের জোগান ভারতে ঢের বেশি কমেছে। এখনও ভারতের জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশ আসে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হয় এই ক্ষেত্রে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণতই নগদ-নির্ভর। স্বাধীনতার পর কোনও একটি সরকারি নীতি ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রকে এত বড় ধাক্কা দেয়নি। সেই ধাক্কা গোটা অর্থনীতিতেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশিই রয়েছে ব্যাঙ্ক আর এটিএম-এ অন্তহীন হয়রানি, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপর তৈরি হওয়া অসহ চাপ, বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনাও।

মশা মারতে কামান দাগার মোক্ষমতম উদাহরণ হিসেবে ডিমনিটাইজেশন ভারতের ইতিহাসে থেকে যাবে। সেই মশা দুর্নীতির ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি ছড়ায়, সেটা মেনে নিলেও সত্যি। তার কোল্যাটেরাল ড্যামেজ বিপুল। ডিমনিটাইজেশন একটা ভুল নীতি, বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা ছাড়়া তার রূপায়ণ হল। নীতিটি তার ঘোষিত লক্ষ্যের কাছাকাছিও পৌঁছোবে না। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অহেতুক বিপন্ন করা হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE