Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

যুদ্ধবাদীরা যুদ্ধ মানে বোঝেন?

নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুই দেশের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের কথা থাক। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ পর্যন্ত ঘোষিত-অঘোষিত বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে চারটি।

পলাশ পাল
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৭ ১২:৫৮
Share: Save:

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অশান্তি চলছেই। থেকে থেকেই নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গুলিবিনিময়ের পাশাপাশি কুলভূষণ যাদব ও কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে দুই রাষ্ট্রের বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির পালাও চলছে। আজকের প্রজন্ম, যারা সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব নৃশংস দৃশ্য দেখছে, এবং যাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের উন্মাদনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে, আমাদের উচিত তাদের সচেতন করে দেওয়া যে, দুটি শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুই দেশের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের কথা থাক। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ পর্যন্ত ঘোষিত-অঘোষিত বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে চারটি। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে প্রায় ২২ হাজার ৬০০ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে, এবং আহতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১ লক্ষ পরিবার যুদ্ধের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ ব্যয়, সঙ্গে সম্পদের ধ্বংস। বর্তমানে উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়র এবং ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নামে দুটি সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধ হলে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে। বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশের ভারসাম্য। ওজোন স্তরের অর্ধেক ধ্বংস হবে। তৈরি হবে প্রবল পারমাণবিক শৈত্য। বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মৌসুমি বায়ুর গতিপথ। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে আবহাওয়ামণ্ডলে যে কার্বন এয়রোসল কণা ছড়াবে তাতে এক দশক পর্যন্ত ধান, গম-সহ খাদ্যশস্য উৎপাদন সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ।

হিরোশিমায় মার্কিন পারমাণবিক বোমায় মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের। আনুমানিক ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগের কারণে। ভারত বা পাকিস্তানের জনবহুল শহরগুলির মধ্যে কোনও একটিতে হিরোশিমার বোমাটির সম-ওজনের একটি বোমা পড়লে এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন এক অগ্নিগোলক তৈরি হবে, যার ভেতরে থাকা মানুষের চামড়ার তৃতীয় স্তর পর্যন্ত পুড়ে যাবে। আর বাতাসে যে ভয়ংকর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে তাতে তৎক্ষণাৎ মারা যাবে কয়েক লক্ষ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে আরও কয়েক লক্ষ মানুষের। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই মারা যেতে পারে ২ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে। হিসেবগুলো খুবই ভয়ের। কিন্তু বিবদমান এই দুটি রাষ্ট্রেই কিছু আবেগতাড়িত রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁদের সহমর্মীরা মনে করছেন, যুদ্ধই একমাত্র সমাধান। সবচেয়ে ভয়ংকর, তাঁরা এ-ও ভাবতে শুরু করেছেন, যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা যায় কি না।

চার-চারটে বড় আকারের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু আমাদের নেতারা তা চান না। পরিণতির চেয়ে জিঘাংসাকে তাঁরা বেশি আরামদায়ক বলে মনে করেন। সুতরাং আমরাও তাঁদের পরিণতির কথাটা মনে করিয়ে দিতে পারি। এবং এটাই আজকের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষেরও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত। কেননা ইতিহাস বলে, একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পাল্টা যুদ্ধের আশঙ্কাই তৈরি করে। নৃশংসতা জন্ম দেয় আরও ভয়াবহ নৃশংসতার। হিটলার পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করতে পারেন, এই আশঙ্কা থেকেই বিজ্ঞানীদের পরামর্শে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রকল্প। চার বছর নিরলস চেষ্টার পর যখন বোমা আবিষ্কার হল, জার্মানি তত দিনে আত্মসমর্পণ করেছে। জাপানের পরাজয়ও প্রত্যাশিত। কিন্তু পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে মার্কিন শাসকরা তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন চিঠি লিখে হামলা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করলেন। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহা মানুষকে পরিণতির কথা ভুলিয়ে দেয়। যুদ্ধ শেষে আইনস্টাইন বলেছিলেন, যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়।

বড় কোনও ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির আগাম হিসাব করা সব সময় সম্ভব নয়। তাই মানুষের মন যুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয় পরিণামের কথা না ভেবেই। সেই সঙ্গে হিংসা ও প্রতিহিংসা যদি সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম হয়, তবে ভারত ও পাকিস্তানের বিগত যুদ্ধগুলির রক্তাক্ত পরিণতিও গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের প্রধান আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। ইতিহাস আমাদের কখনও কখনও পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা এখন সে-রকম একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মানবসভ্যতাকে সুরক্ষিত রাখতে আমরা কোন পথে হাঁটব— প্রতিহিংসা, না পারস্পরিক আলোচনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE