Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নিষ্ঠুর

আবার সন্ত্রাস। ঘৃণ্যতম, নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাস। একবিংশ শতকের বিশ্বদুনিয়া বহু সন্ত্রাস-দীর্ণতার মধ্য দিয়া আসিয়াছে, আসিতেছে, তবু ইস্টার দিবসে দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায় যাহা ঘটিয়া গেল, তাহাকে অভূতপূর্ব বলা যায়।

ছবি এপি।

ছবি এপি।

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

আবার সন্ত্রাস। ঘৃণ্যতম, নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাস। একবিংশ শতকের বিশ্বদুনিয়া বহু সন্ত্রাস-দীর্ণতার মধ্য দিয়া আসিয়াছে, আসিতেছে, তবু ইস্টার দিবসে দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায় যাহা ঘটিয়া গেল, তাহাকে অভূতপূর্ব বলা যায়। পর্যবেক্ষক-গবেষকদের মতে ইহা ‘ব্র্যান্ড-নিউ’ গোত্রের। সরকারি ভাবে অপরাধীর পরিচিতি না পাওয়া গেলেও যোগসাজশের চিহ্নসূত্রে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার অনেকে। কোনও বড় মাপের ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁহারা যুক্ত, এমনই অনুমান করা হইতেছে। অধিকাংশ হতাহত শ্রীলঙ্কার অধিবাসী হইলেও অনেক বিদেশি আছেন তালিকায়। বড় মাপের হোটেল বাছিয়া লওয়ার মধ্যেও বিদেশি অভ্যাগতদের নিশানা করিবার লক্ষ্যটি পরিস্ফুট। নিউজ়িল্যান্ডের মসজিদ সন্ত্রাসের কিছু দিনের মধ্যেই শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টীয় পরবের দিন চার্চে জড়ো-হওয়া মানুষের উপর হামলা চালানোর ভাবনাটিও এক ধরনের অনুমান উস্কাইয়া দিতেছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চটি এখন সন্ত্রাস ও প্রতিসন্ত্রাসে নিমজ্জিত। আর সেই মঞ্চে দাপাইয়া বেড়াইতেছে রক্তলোলুপ জিঘাংসু বাহিনী। মানুষ যে মানুষের কত বড় শত্রু, তাহা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নামিয়াছে তাহারা। অনেকে বলেন, যতই সন্ত্রাস ঘটুক, আধুনিক দুনিয়া নাকি পূর্বাপেক্ষা অনেক কম মানুষকে অপঘাতে মরিতে দেখিতেছে। ইহার একটিই উত্তর: আধুনিক মানুষের মরণশীলতার বিষয়টি সংখ্যা দিয়া নহে, আকস্মিকতা দিয়া বুঝার বস্তু। যে আট বৎসরের কন্যা বিদ্যালয়ের ছুটিতে পরিবারের সহিত আনন্দময় নিসর্গভ্রমণে আসিয়াছিল, মুহূর্তমধ্যে অসহায় পিতামাতার সামনে তাহার দেহটি রক্তাক্ত পিণ্ডে পরিণত হইবার মধ্যে জীবনের নশ্বরতা খুঁজিতে হয় আজ।

শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে নাকি কিছু সতর্কবার্তা আসিয়াছিল। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর অতর্কিত আক্রমণ আটকাইবার পন্থা বাহির করা যে সহজ কথা নয়, তাহা সকল দেশই জানে। দুর্ভাগ্য আটকানো যায় নাই। বিশেষত যে শ্রীলঙ্কা বহু হিংসা ও রক্তবন্যার পথ পার হইয়া এক প্রকার স্থিতিতে ফিরিতেছিল, তাহার জন্য এই আক্রমণ এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। জাতিবিদ্বেষ-জর্জরিত দ্বীপদেশটি গত কয়েক বৎসর একটু স্বাভাবিকতার মুখ দেখিতেছিল। তামিল গেরিলা বা বৌদ্ধ বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী জনতা বা সরকারি দমনবাহিনী— এই সব হইতে কিছু দিন মুক্তি আস্বাদ করিতেছিল। সম্প্রতি নির্বাচন লইয়া প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের তরজা তুঙ্গে উঠিলেও সেই রাজনীতি অসামরিক জীবনকে ধ্বস্ত করিতে পারে নাই। শ্রীলঙ্কার এই পরিবর্তন একটি বড় আন্তর্জাতিক ঘটনা বলিয়া প্রতীত হইতেছিল। স্বভাবতই আজ প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহের আক্ষেপের সহিত বহু দেশনেতাই তাই একমত হইতেছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যতিক্রম। নিয়মমাফিক প্রধানমন্ত্রী-সুলভ দায়সমূহ তিনি সারিয়াছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অত্যন্ত অনৈতিক কিছু কাজ করিয়াছেন। হৃদয়বিদারক সংবাদ আসিবার পরই নিজের নির্বাচনী প্রচারে শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গ টানিয়া দলীয় ‘লাইন’টি জনগণের কাছে পৌঁছাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। একমাত্র বিজেপির পেশিশক্তিসমৃদ্ধ জাতীয়তাবাদই যে ভারতকে নিরাপদ রাখিতে পারে, এমন একটি বক্তব্য তিনি ও তাঁহারা সর্বদাই পেশ করিয়া থাকেন। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের মহাদুর্যোগকে ‘কাজ’-এ লাগাইবার এই ব্যস্ততা কেবল দৃষ্টিকটু নহে, অসহনীয়। নিজের রাজনীতির সঙ্কীর্ণতা মোদী নিজেই আবার প্রমাণ করিয়া দিলেন। যে প্রহরে কেবল দুঃখজ্ঞাপন ও পাশে থাকিবার প্রতিশ্রুতি ছাড়া প্রতিবেশীর কিছুই বলিবার থাকে না, সেই মুহূর্তকেও তিনি নিজের দলের ভোট চাহিবার সুযোগে পরিণত করিলেন। শ্রীলঙ্কার প্রতি ভারতের নাগরিক সমাজের দিক হইতে তাই একটি অতিরিক্ত বার্তা এখন জরুরি: নিজেদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার বার্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sri Lanka Blast Suicide Bombing Terrorism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE