Advertisement
E-Paper

মানুষের ধর্ম, ধর্মের ষাঁড়

মফস্সল শহরের প্রধান রাস্তা জুড়ে তিনি শুয়ে। দু’পাশে থমকে রিকশা, গাড়ি, মোটরবাইক। তীব্র হর্ন, চিৎকৃত গালিগালাজ। শেষে এক ভ্যানচালক জলের বোতল থেকে গায়ে জল ছিটিয়ে দিতেই হেলতে-দুলতে চলে গেলেন।

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৭ ১২:১০

মফস্সল শহরের প্রধান রাস্তা জুড়ে তিনি শুয়ে। দু’পাশে থমকে রিকশা, গাড়ি, মোটরবাইক। তীব্র হর্ন, চিৎকৃত গালিগালাজ। শেষে এক ভ্যানচালক জলের বোতল থেকে গায়ে জল ছিটিয়ে দিতেই হেলতে-দুলতে চলে গেলেন। মানুষের অভদ্রতায় বিরক্ত। বছর আটেক আগে সেই প্রথম দেখা। তখন তিনি জোয়ান। চকচকে গা, সটান দুটো শিং। সে বারই ফের দেখা হয়েছিল গ্রামের ভিতর। মাঝ-বৈশাখের কচি পাটপাতা চিবোচ্ছেন। যেন তিনিই জমির মালিক। কী দেমাক!

বছর পাঁচেক পরে তাকে আর চেনা যায় না। পিঠের একটা অংশে পুড়ে গিয়ে দগদগে ঘা। ভনভন করছে মাছি। পেটের আশপাশে অজস্র ক্ষত। চোখ দু’টোর নীচে শুকনো রক্তের দাগ। হাঁটার গতিও বেশ শ্লথ। গ্রামের এক প্রৌঢ় বললেন, ‘দেখো কী হাল করেছে! জল ছিটিয়ে দিলেই ও তো সরে পড়ে। এ ভাবে কেউ মারে?’ খেত থেকে বাড়ির পথে এক চাষি ঠিকরে উঠলেন, ‘তবে কি পুজো করবে? তোমার জমিতে ঢুকলে বুঝতে!’

ভাগের মা গঙ্গা পায় না, ধর্মের ষাঁড়ের জাবনা জোটে না। যে সবার, সে কারও নয়। প্রথম দিকে কেউ কেউ সব্জি, ফলমূল ছুড়ে দেয়। তার পর শুরু হয় খেতের ফসল খাওয়া। ক্ষিপ্ত চাষি এমন ‘শিক্ষা’ দিতে চায় যাতে ষাঁড়ের ফের সাহস না হয় জমিতে নামার। এক দিন মাঝরাতে শোনা গিয়েছিল বিকট গর্জন। সকালে দেখা গেল, ষাঁড়ের পিঠে দগদগে ঘা। কারা অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে।

ষাঁড়ের খিদে মেটে না, শিক্ষাদানও চলতে থাকে। তবে গোপনে। ধর্মের ষাঁড়কে প্রকাশ্যে আঘাত করলে বিপদ আছে। তাই রাতের অন্ধকারে ইলেকট্রিক শক। পেট ও চোখের আশপাশে বল্লমের খোঁচা। এক বার দেখা গেল, ফলাটা বিঁধেই আছে পিঠে। কাছে গিয়ে তা বের করার সাহস আছে কার? ইটের ঘায়ে চোখও জখম। এক চোখে দেখে বলে ষাঁড়টা আর সোজা হাঁটতে পারে না। রাস্তার বাঁ দিক বরাবর চলতে চলতে জমিতে নেমে পড়ে, তার পর গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। খুরের তলায় ফসলের দফারফা। চাষিরা তেড়ে যায়, ষাঁড়ও গুঁতোতে যায়। জখম হয়ে কত লোক গিয়েছে ব্লক হাসপাতালে। ধর্মের ষাঁড় নিয়ে প্রশাসনেরও মাথাব্যথা। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বহরমপুর সফরে গেলে তৎকালীন ধর্মের ষাঁড় শম্ভুর জন্য পুলিশের একটি দলকে মোতায়েন করা হয়েছিল। কনভয়ের যাত্রাপথে শম্ভু না ঢুকে পড়ে।

বেওয়ারিশ প্রাণীর কী হবে, গ্রামে সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। গাড়ি-টানা ঘোড়াকে নিশুতি রাতে ঘোড়ার মালিক ছেড়ে দিয়ে আসেন দূরের কোনও মাঠে। যাতে পথ চিনে আর ঘরে ফিরতে না পারে। তার পর সে-ও পেট ভরাতে গিয়ে লাঠির বাড়ি, আগুনের ছ্যাঁকা খায়। মারার নিয়ম নেই, বাঁচিয়ে রাখার রেস্তও নেই। শেষে গাড়ি চাপা পড়ে, নইলে এক দিন তার দেহ মেলে নির্জন মাঠে। বাড়ির গরুর দুধ কমে গেলে তাকে ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করা যে গ্রামে নিয়ম, ধর্মের ষাঁড়ের গায়ে সেখানেও কেউ হাত দিতে পারে না। ষাঁড় মারা গেলে চাঁদা তুলে ঘটা করে শ্রাদ্ধও হয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে ছুড়ে দেওয়া কলাটা-আলুটা, এই তার প্রাপ্তি।

অথচ ষাঁড়কে সামনে রেখে টাকা-তোলার একটা চক্র চলে। অমুক ষাঁড়কে মেরেছে, তমুক বিক্রি করেছে কসাইয়ের কাছে, এমন নানা অভিযোগে গ্রাম-সম্পর্কিত কাকা-জেঠাদের ‘বিচার’ হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপার নেই, কেবল জরিমানা নিয়ে দর কষাকষি। টাকার অঙ্ক কম নয়, আট-দশ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লক্ষ টাকাও ওঠে। পারদ বেশি চড়লে পুলিশ আসে। ষাঁড় এক রাত কাটায় থানার হেফাজতে। কিন্তু খড়-ঘাস জোটানোর হ্যাপা অনেক। পুলিশ দু’পক্ষকে ধমকে খালাস করে দেয় ষাঁড়কে। আবার শুরু তার হেনস্তার জীবন।

ব্যতিক্রমও আছে। নদিয়ার সীমান্তের এক গ্রামে নিয়ম, ষাঁড় গ্রামে ঢুকলে কিছু দিন তার মালিকের খোঁজ করা হয়। না মিললে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। টাকা জমা পড়ে স্থানীয় মন্দির কিংবা ট্রাস্টের তহবিলে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী বা ধর্মীয় সংস্থা বেওয়ারিশ প্রাণীদের সেবা করে। মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে একটি গোশালায় বৃদ্ধ ঘোড়া, গরু রাখা হয়। কিন্তু দুটি-তিনটি জেলায় এমন একটি আশ্রয়, কে টাকা খরচ করে সেখানে পৌঁছতে যাবে বেওয়ারিশ প্রাণীকে?

বৈশাখের গরমে কালো পিচ-রাস্তার ধারে একটু ছায়া খুঁজে বসে-থাকা ষাঁড়টা প্রায়-অন্ধ চোখ মেলে চেয়েছিল। তার গায়ের এক একটি ক্ষত নিয়ে এক একটি সালিশি হয়েছে। নির্যাতনের জরিমানা আদায় করে বেশ কয়েকটা মন্দিরের চাতাল বাঁধানো হয়েছে মার্বেলে। সে তো ধর্মেরই কাজ। নাকি, ধর্ম মানে অন্য কিছু?

Bulls Religion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy