Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জরুরি ভর্ৎসনা

প্রস্তাবিত রথযাত্রায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা পড়িতে পারে, রাজ্যের সামাজিক স্থিতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বস্ত হইতে পারে, তাহা কি প্রশাসন পরে জানিল?

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কলিকাতা হাইকোর্ট রাজ্য প্রশাসনকে যে কঠিন ভর্ৎসনা করিয়াছে, তাহা হইতে সরকার কি কোনও শিক্ষা লইতেছে? সম্ভবত না। কেননা এই দেশে শাসনবিভাগের স্বভাবই হইল, যথার্থ পথে কাজ করিবার অক্ষমতা, আর বিচারবিভাগের দায়ই হইল, নিয়মিত ভাবে শাসনবিভাগের অকৃত কাজের ভার নিজ স্কন্ধে বহন। শাসনবিভাগের এই উপর্যুপরি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এখন এ দেশের রাজনীতির অাবশ্যিক ধর্ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নতুবা বোঝা অসম্ভব, এই রাজ্যে বিজেপির রথযাত্রা ঘোষণা ইস্তক এত দিন কাটিয়া যাইবার পর রাজ্য সরকারের টনকটি হঠাৎ শেষবেলায় নড়িল কেন। প্রস্তাবিত রথযাত্রায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা পড়িতে পারে, রাজ্যের সামাজিক স্থিতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বস্ত হইতে পারে, তাহা কি প্রশাসন পরে জানিল? যে কোচবিহার হইতে যাত্রা শুরু হইবার কথা— সেই জেলায় যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার প্রবল সম্ভাবনা, এই বোধোদয় কি এত দিনে ঘটিল? একটি রাজনৈতিক দল কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করিলে রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাহা কত দূর নিরাপদ, এই বিবেচনা কি প্রশাসনের নয়? বাস্তবিক, রাজ্য সরকারকে রাজনৈতিক বিরোধিতায় যতটা সক্রিয় দেখা যায়, প্রশাসনিক বিবেচনায় সেই সক্রিয়তার ধারেকাছেও যাইতে দেখা যায় না। যদি বা সরকার সক্রিয় হয়, তাহা নিতান্ত ছোট বিষয়গুলিতে। যেমন, ছোট একটি রাজনৈতিক দল কলিকাতার হল-এ বাৎসরিক কর্মসূচি করিবার অনুমতি চাহিলে প্রশাসন ত্বরিতে তাহা বানচাল করে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দল গোটা রাজ্য জুড়িয়া বিপজ্জনক কর্মসূচি গ্রহণ করিলে প্রশাসন আঙুলটিও না নাড়াইয়া বসিয়া থাকে। উল্লেখযোগ্য, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা কিন্তু একান্ত ভাবেই রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত কাজ। ইহা না করিতে পারার কোনও যুক্তিই গ্রাহ্য নয়।

হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সরকারকে বিজেপির সহিত একযোগে বসিয়া ‘আলোচনা’ করিতে বলায় রাজ্য প্রশাসন নাকি অসন্তুষ্ট! এমন একটি সম্প্রীতি-ধ্বংসকারী কার্যক্রমের পরিকল্পনা যে দল করিতে পারে, তাহার সহিত আবার আলোচনা কিসের— এই হইল যুক্তি। ডিভিশন বেঞ্চ উল্টাইয়া বলিতেই পারে যে, সম্প্রীতি ধ্বংসের নিশ্চয়তা যখন এতটাই, সে ক্ষেত্রে প্রশাসন আগে হইতে কাজ করিলে হয়তো আদালতের ভূমিকার দরকার পড়িত না। এখন, আদালতের বক্তব্য শুনিবার পর প্রশাসনের অসন্তোষের সংবাদ পাইয়া অনুমান করা চলে যে— আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখিয়াই আসলে রাজ্য সরকার পুরা কাজটি হাসিল করিতে চায়। সমস্যা এইখানেই। বিচারবিভাগের উপর অকারণ প্রশাসনিক দায় চাপাইবার প্রবণতাটি অত্যন্ত আপত্তিকর।

এমন প্রবণতা কিন্তু কেবল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের নহে, দেশব্যাপী লক্ষণীয়। কেন্দ্রীয় সরকারও বহু ক্ষেত্রে নিজের কাজ হয় অবহেলাবশত নয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবশত না করিয়া বিচারবিভাগের কোর্টে বল ঠেলিবার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক, তাহার পর আদালত, এমনকী সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধেও অতিসক্রিয়তার অভিযোগ আনিয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট কিছু কাল আগে বলিয়াছে যে, সমাজের নিকট সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা একটি বিভাগ না দেখাইলে অন্য বিভাগকে অনিচ্ছুক ভাবেই তাহা দেখাইতে হয়। সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি বলিয়া দেয়, সুপ্রিম কোর্ট ঠিক কী বলিতে চাহিয়াছিল— কী ভাবে এক পক্ষের অসক্রিয়তা অন্য পক্ষের অতিসক্রিয়তায় পর্যবসিত হয়। গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা ঘোর অমঙ্গলজনক। অর্থাৎ শুধু রথযাত্রা নয়, রথযাত্রায় প্রয়োজনীয় বিরোধিতার অভাবও এই দেশের সমাজকে অ-সুস্থ করিয়া ফেলিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE