চল্লিশ বৎসর দীর্ঘ সময়। একে একে গণহত্যাকারীরা ধরাধাম ত্যাগ করিবার পরে অবশেষে শাস্তি হইল কম্বোডিয়ার অবশিষ্ট দুই খমের রুজ় নেতা নুয়োন চেয়া এবং খিউ সাম্ফানের। বর্তমানে যথাক্রমে ৯২ এবং ৮৭ বৎসর বয়সি দুই কমিউনিস্ট নেতা ‘গণতান্ত্রিক কাম্পুচিয়া’র আইনসভা এবং রাষ্ট্রপ্রধানের আসন অলঙ্কৃত করিতেন। ইতিপূর্বে, তৎকালীন পার্টির প্রধান পল পট দীর্ঘ কাল আত্মগোপন করিয়া ধরা পড়িয়াছিলেন। তাহার এক বৎসরের ভিতর, ১৯৯৮ সালে, তাঁহার মৃত্যু হয়। খমের রুজ় সংঘটিত গণহত্যা লইয়া বিস্তর চর্চার এত কাল বাদে শাস্তি বিধান হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘসূত্রী বলিলে ভ্রম হয় না। তবে সুবিচার আসিল— ইহা অধিক জরুরি। বস্তুত, যে সকল ক্ষুদ্র দেশে বারংবার রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটে, সেই স্থলে সুবিচারের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হইবেই। বাংলাদেশে রাজাকারদের বিচারপ্রক্রিয়া এবং শাস্তি বিধানের সহিত তুলনা চলিতে পারে। প্রসঙ্গত, খমের রুজ়ের শাসন প্রতিষ্ঠা হইবার পাঁচ বৎসর পূর্বেই সেনাবাহিনী কম্বোডিয়া দখল করিয়াছিল। সশস্ত্র সংগ্রামে উহাদের হটাইয়া ত্রাণকর্তা খমের রুজ়কে বরণ করিয়াছিলেন দেশবাসী।
ধূসর হইয়া যাওয়া ইতিহাসকে ফিরিয়া পড়িলে স্মরণ করিতে হয়, খমের রুজ় ‘কী করিয়াছিল’। ‘কী করে নাই’ বলিলে উত্তর সহজ। জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতে মিল না হইলে নির্যাতন, দাসত্ব, হত্যা— কোনও চরম পথই বাছিয়া লইতে কুণ্ঠিত হইত না তাহারা। সেই লক্ষ্যে বিদ্যালয় পরিণত হইয়াছিল কারাগারে, ফলের বাগান হইয়াছিল গণকবর। ‘মধ্যযুগীয়’ পন্থায় (যাহা আধুনিক সভ্যতায় অবর্ণনীয়) অত্যাচার চলিত। মাত্র চার বৎসরের শাসনকালে সতেরো লক্ষ দেশবাসীকে হত্যা করিয়াছিল তাহারা। সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল খমের রুজ়ের ঘোষিত লক্ষ্য। সেই পথ অবলম্বন করিতে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়িয়া তুলিবার পথ গ্রহণ করা হইয়াছিল। যাঁহারা বাধাস্বরূপ ঠেকিতেন, দুনিয়া হইতে বিদায় দেওয়া হইত তাঁহাদের। এই অত্যাচার দেশবাসীর পক্ষে বিস্মৃত হওয়া অসম্ভব— কম্বোডিয়ায় সংগ্রহশালার ন্যায় সজ্জিত আছে মড়ার খুলির স্তূপ।
সুতরাং, ইহাদের শাস্তি বিধানের গুরুত্বটি বর্তমান শাসনকাঠামোতেও নিহিত। খমের রুজ়ের পতনের কিছু কাল পর হইতে দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক যাবৎ দেশ শাসন করিতেছেন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। স্মরণে রাখা আবশ্যক, খমের রুজ় আমলের সেনাবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার হিসেবেই তাঁহার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। যথাসময় শিবির পরিবর্তন করিয়া সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হইয়াছেন তিনি। বর্তমানে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হইতে বিরোধী স্বরের দমন— হুন সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। পাঁচ বৎসর অন্তর গণতন্ত্রের উৎসব উদ্যাপিত হইলেও বাস্তবে হুন সেনের দলই জয়লাভ করিয়া থাকে। গত জুলাই মাসে আয়োজিত কোনও বিরোধী প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে ১২৫টি আসনেই জিতিয়া যায় তাঁহার দল। অতএব, বিচারের প্রজ্বলিত প্রদীপের নীচেই আশঙ্কার কালো ছায়াটি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইতে থাকে। যে স্বৈরাচারের প্রতি ঘৃণা পোষণ করিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, তাহাও বিশ্বাসঘাতকতা করিলে বুঝিতে হয়, বিচারবিভাগের বল সীমিত। সদিচ্ছা রাজনৈতিক না হইলে জনতার লাভ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy