Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতা, সংখ্যাগুরুর কৃপা

এ বারের স্বাধীনতা দিবসে কী করবেন ফারুক আহমেদ দার?

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:২০
Share: Save:

এ বারের স্বাধীনতা দিবসে কী করবেন ফারুক আহমেদ দার? বাড়ির সামনে ভারতের পতাকা ওড়াবেন, না কি আরও সেঁধিয়ে যাবেন ঘরের অন্ধকারে? বাইরের পৃথিবীটা তো তাঁর কাছে জলপাই-রঙা, সে পৃথিবীর মাটিতে শুধু ভারী বুটের ছাপ!

ফারুক এখন সেলেব্রিটি! দেশ-বিদেশের মানুষ এই কাশ্মীরি যুবককে চেনেন। গত বছরের ৯ এপ্রিল থেকেই চেনেন। এ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত করার দিন ছিল সেটি। শ্রীনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিন দরিদ্র পরিবারের ওই যুবককে জিপের বনেটের সামনে রাখা টায়ারের উপরে দড়ি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রেখে মানবঢাল করে ঘুরিয়েছিল রাষ্ট্রীয় রাইফেলস। ফারুককে ‘সেলেব্রিটি’ বানিয়েছিলেন যিনি, সেই মেজর লিটুল গগৈ প্রশংসিত হয়েছিলেন সেনাকর্তাদের কাছে। কিন্তু এই এক বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে জানা গেল না যে, ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে কারও সাজা হয়েছে কি না।

যেমন জানা নেই, এই যে স্বাধীনতার উদযাপন, ফারুকের কাছে, ফারুকদের কাছে তার মূল্য কতটা! ভূমিপুত্র হয়েও যাঁদের পকেটে পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয়, যখন তখন বেয়নেটধারীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, সন্দেহ হলেই তুলে নিয়ে যায় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী অথবা পুলিশ, যেখানে ছররা বন্দুকের আশীর্বাদে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেয় যুবকযুবতীরা, সেখানে কোন স্বাধীনতা উদযাপন করা যেতে পারে, হে স্বদেশ?

জানি, ‘মূল ভারত’-এর অনেক মানুষজনই বলবেন, ‘ওরা’, কাশ্মীরিরা ‘আমাদের’ স্বাধীনতা দিবস পালন করে নাকি? ‘ওরা’ তো আগের দিন পাকিস্তানের পতাকা তোলে! এ কথা বলার জন্য অবশ্য তথ্যপ্রমাণের বিশেষ প্রয়োজন হয় না, ভেবে নিলেই হয়। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ভেবে নেওয়াটা সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়ার যুগ!

এই যেমন অসমে স্বাধীনতা দিবসের কয়েক দিন আগে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ যেন পরাধীন হয়ে গিয়েছেন। চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবু হঠাৎই যেন লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের তলা থেকে দেশের মাটি সরে যাচ্ছে! ধরে নেওয়া যাক, এঁদের মধ্যে অনেকেই ‘প্রয়োজনীয় নথি’ পেশে অপারগ হবেন। এত বছর ধরে এ দেশে থাকার পরে তখন তাঁদের কোথায় পাঠানো হবে? অন্য দেশ তাঁদের নেবে? নিশ্চয়ই নেবে না। তা হলে? ডিটেনশন ক্যাম্প? এ কেমন স্বাধীনতা?

সকলেরই যে স্বাধীনতা হরণ হচ্ছে তা নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান মানুষের কোনও ভয় নেই। তাঁরা শরণার্থী। স্বাগত তাঁরা এই দেশে। গত ১১ অগস্ট কলকাতার জনসভায় দাঁড়িয়েও সে কথাই সাফ জানিয়ে গিয়েছেন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ।

মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্ব। আরএসএসের এই দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মনে করতেন, দেশের শত্রু মূলত তিনটি গোষ্ঠী: মুসলিম, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্ট। তাঁর ‘আ বাঞ্চ অব থটস’ গ্রন্থে এ কথা তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছিলেন। গোলওয়ালকর যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন সেই রাষ্ট্র গঠনের আর বোধ করি খুব বেশি দেরি নেই। এ বারের স্বাধীনতা দিবসটা সত্যিই বেশ অন্য রকম লাগছে!

স্বাধীনতার রকমফের দেখলে চমৎকৃত হতে হয় বইকী! ক’দিন আগে রাজস্থানের অলওয়ার জেলার রামগড়ের বিজেপি বিধায়ক জ্ঞানদেব আহুজা ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন: হিন্দু ধর্মের যে মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, পনেরো দিন থেকে এক মাস সময় দেওয়া হচ্ছে, সেই মেয়েদের ফেরত দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে যারা নিয়ে যাচ্ছে তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত দ্বিগুণ মেয়ের বিপদ হবে। অর্থাৎ, স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক ভালবেসে ভিন্ন ধর্মের কারও সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারবে না।

জ্ঞানদেব আহুজা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, মধ্যপ্রদেশের রাজগড়ে বজরং দল এগিয়ে গিয়েছে আরও এক ধাপ। দেশে গোহত্যা বাড়ছে, দেশবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে, বেড়ে যাচ্ছে ‘লাভ জিহাদ’! অতএব, এ সব ঠেকাতে দেশভক্তদের নিয়ে রীতিমতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে ফেলেছে তারা। সঙ্গত কারণেই কংগ্রেস প্রশ্ন তু‌লেছে, দেশে যখন সশস্ত্র বাহিনী আছেই, এবং তারা দেশকে রক্ষা করে চলেছে, তখন জাতীয়তাবাদের নামে তরুণ প্রজন্মকে খুনে বানানোর প্রয়োজন কোথায়?

আসল সত্যটা লুকিয়ে আছে ওই জাতীয়তাবাদ শব্দটার মধ্যেই! ২০১৯-এর আগে ওটাই যে মস্ত বড় ইউএসপি! এই শব্দটার মধ্যে দিয়েই বপণ করা হচ্ছে ভয়ের বীজ। সর্বগ্রাসী ভয়! গরুর মাংস আছে বুঝি, মার, মার ওকে! মেরে ফেল! ভোরবেলায় গরু নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? দুধ বেচতে? বাজে কথা! লোকটা হাত জোড় করে কী বলছে শোনার দরকার নেই। পিটিয়ে শেষ করে দে।

উত্তরপ্রদেশে মুসলিমপ্রধান খইলান গ্রামের মধ্য দিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালতে কাঁধে বাঁক নিয়ে ‘কাঁওয়ার’ যাত্রার সময় শিবভক্তদের সঙ্গে গন্ডগোল এড়াতে পুলিশ ওই গ্রামের আড়াইশো পরিবারকে ‘লাল কার্ড’ দিয়েছে। গত বছর এই খইলানেই দুই সম্প্রদায়ে সংঘর্ষে কয়েক জন আহত হন। এ বার পুলিশের দেওয়া লাল কার্ড দেখে গ্রামের ৭০টি মুসলিম পরিবার গ্রাম ছেড়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে লাল কার্ড দিলেও মেরঠে শিবভক্তদের উপরে হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছেন পুলিশকর্তারা। স্বাধীনতা!

হ্যাঁ, স্বাধীনতা। আমার শর্তে থাকতে পারলে তুমি স্বাধীন। যতটা স্বাধীনতা আমি তোমাকে দেব, সেটাই তোমার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধীনতা। আমাদের কাছে নিজেদের নিবেদন করো। আমরাই ঠিক করব, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব না রাখব না। না মারি যদি, ভয় দেখাব। সমাজকে শেখাব, শত্রুর শেষ রেখো না, নিকেশ কর। ঘৃণা ছড়িয়ে দেব। বিচারব্যবস্থার সমান্তরাল তালিবানি বিচার চালাব। মাথা নত করে রাখো। না হলে ডিটেনশন ক্যাম্প!

লাল কেল্লা সেজেছে। স্বাধীনতা উদযাপনের প্রস্তুতি চলেছে দিকে দিকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে দেশবাসীর কাছে ‘আইডিয়া’ চেয়েছেন ১৫ অগস্টের ভাষণের জন্য!

‘আইডিয়া’? যুক্তিহীন, বোধবুদ্ধিহীন ‘আইডিয়া’ ছাড়া এ দেশে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE