Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভাদুর কদর যেন না কমে

ভাদু কোনও লৌকিক বা বৈদিক দেবী নন। কেউ কেউ বলেছেন ‘করম’ নামক আদিবাসী উৎসবের হিন্দু সংস্করণ হল ভাদু। কিন্তু ‘জাউয়া’ (মতান্তরে জাওয়া) গানের সঙ্গে ভাদুগানের কোনও মিল পাওয়া যায় না। এই উৎসব আসলে ফসল ফলানোর উৎসব।

ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাদু প্রতিমা। ফাইল চিত্র

ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাদু প্রতিমা। ফাইল চিত্র

পার্থসারথি গোস্বামী
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১৮
Share: Save:

বাঁকুড়া-পুরুলিয়া তথা দক্ষিণবঙ্গের সাদামাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষ যে সব লোকউৎসব পালন করেন, সেখানে প্রাচুর্য ও বিলাসিতার ডঙ্কা-নিনাদ শোনা যায় না। সেগুলি যেন প্রাণের স্পন্দনের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। দক্ষিণবঙ্গের তেমনই এক প্রাণের উৎসব হল ‘ভাদু পুজো’। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে এমন কোনও গ্রাম পাওয়া মুশকিল, যেখানে ভাদ্র সংক্রান্তির সন্ধ্যার আকাশ-বাতাস ভাদুগানের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে না।

পুজো শব্দটি শোনামাত্রই আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে ধূপধুনা, চন্দন পুরোহিত, মন্ত্রপাঠ ইত্যাদি। না। ভাদু সম্পূর্ণ ভাবে যে কোনও ধর্মীয় আড়ম্বর, মন্ত্রপাঠ, পুরোহিত বর্জিত এক প্রাণের পুজো। যে পুজোর মূল মন্ত্র হল গান। বঙ্গীয় রমণীরা শুধু ভাদু গানের মাধ্যমেই প্রাণোচ্ছ্বল ভাবে উদ্‌যাপন করেন এই উৎসব।

ভাদু কোনও লৌকিক বা বৈদিক দেবী নন। ভাদুপুজোর উৎসের সন্ধানে গেলে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় একটি কিংবদন্তী। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবংশের সিংহাসন আরোহণ করেন রাজা শ্রী নীলমণি সিংহদেও। কথিত আছে, রাজা নীলমণির এক কন্যা ছিলেন যাঁর নাম ছিল ভদ্রেশ্বরী। কেউ কেউ বলেন, বিবাহের পরে শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় পথমধ্যে দস্যু আক্রমণে ভদ্রেশ্বরীর স্বামী প্রাণ হারান। স্বামীর শোকে ভদ্রেশ্বরীও আত্মহত্যা করেন। আবার কেউ বলেন তিনি বিবাহের পূর্বেই মারা যান। আবার কেউ বলেন তিনি বিবাহিতা ছিলেন, কিন্তু স্বামীর ঘর করতেন না। সেই কন্যার অকালমৃত্যুতে রাজা তাঁর স্মৃতিরক্ষায় চালু করেন ভাদুপুজো।

কিন্তু এই লোককথার কোনও ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। ইতিহাসে রাজা নীলমণি সিংহদেও বাহাদুরের কোনও কন্যাসন্তানের উল্লেখ নেই। ভদ্রেশ্বরীকে রাজার মানসকন্যা ধরে নিলেও, ইতিহাসে এমনকি, কোনও ভাদুগানেও তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। যেখানে নানা ঘটনার কথা উঠে এসেছে পুরাতন ভাদুগানে। যেমন, কাশীপুরের রাজবাড়িতে যে ভাদুপুজো হত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি গানে, ‘কাশীপুরের মহারাজা/ সে করে ভাদুপূজা/ হাতেতে মা জিলপি খাজা/ পায়েতে ফুল বাতাসা’। কেউ কেউ বলেছেন ‘করম’ নামক আদিবাসী উৎসবের হিন্দু সংস্করণ হল ভাদু। কিন্তু ‘করম’ উৎসবে গাওয়া ‘জাউয়া’ (মতান্তরে জাওয়া) গানের সঙ্গে ভাদুগানের কোনও মিল পাওয়া যায় না।

এই উৎসব আসলে ফসল ফলানোর উৎসব। সাধারণত, রোহিণী নক্ষত্রের উদয়কালই ছিল ধানের বীজ বপনের নির্দিষ্ট তিথি। প্রথা মেনে বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় প্রচলিত লোকউৎসব ‘রৈণি’ (রোহিণী) উপলক্ষে বীজ বপন করে কৃষিকার্য চলত ভাদ্রের শুরু পর্যন্ত। এই সময়টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর পরে ভাদ্রমাস সবার বিশ্রামের মাস। মহিলাদের হাতেও তেমন কাজ নেই। আর কিছু দিন পরে সোনার ফসল ঘরে তোলার পালা। সারা বছর অনটনে কাটানোর পরে খুশির দিন আগতপ্রায়। আর সেই খুশির শুভ সূচনার দিন হল ভাদু পুজো।

উৎপত্তির কারণ যা-ই হয়ে থাকুক, ভাদু দক্ষিণবঙ্গের মহিলাদের প্রাণের পরব। উপাচার, আয়োজন সামান্যই। বাকিটা শুধু গান আর গান। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন, পাড়ার মহিলারা কারও ঘরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে, সেখানে তক্তপোষ দিয়ে একটি ম্যারাপ বা মঞ্চের মতো প্রস্তুত করেন। এর ওর থেকে রংবেরঙের শাড়ি এনে এবং নানা ঘরোয়া জিনিস দিয়ে সেই মঞ্চকে করেন সুসজ্জিত। কোনও মৃৎশিল্পীর গড়া এক সুন্দর নারী প্রতিমা এনে সেটিকে ওই মঞ্চে একটি বেদিতে স্থাপন করা হয়। সাজসজ্জা আরও আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হয় শালুক ফুল। মহিলারা ঘরের কাজ সেরে সন্ধ্যা নাগাদ, সুসজ্জিত হয়ে হাতে মিষ্টি, চিঁড়ে, খাজা, ঘরে তৈরি গুড়-পিঠে, ফল প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ থালা নিয়ে, ভাদু মূর্তির চারপাশে সেই থালা সাজিয়ে নিজেরা শতরঞ্চি বা মাদুর পেতে সমবেত কণ্ঠে শুরু করেন ভাদু গান। এই গানগুলির মধ্যে ফুটে ওঠে একেবারেই নিখাদ নারী সমাজের মনের কথা। কখনও আবার দলবেঁধে মহিলারা অন্যের ভাদু দেখতে যান। যান অন্যের ভাদু গানের বিষয়বস্তু শুনতে বা তাদের পাড়ায় গান করতে।

অন্য দল বা পাড়ার মেয়েরা ভাদু দেখতে বা গান গাইতে এলে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানোর রীতিটিও বেশ আকর্ষণীয়। অভ্যর্থনা জানানো হয় গানের মাধ্যমেই। ‘ভাদু বৈলতে আলি তোরা/ বৈসলো তোরা ছাঁচকোলে/ পাৎনা ভৈরে মাড় রাখ্যেছি/ খা লো তোরা প্যাট ভৈরে’। ভাদু দেখতে এসে বা গান গাইতে এসে অন্যের ভাদুর কোন খুঁত দেখতে পেল তার সমালোচনা করতেও ছাড়েন না কেউ , ‘এই ভাদুটি কে গৈড়েছে/ নীলু ছুতার মিস্তিরি/ গড়নে গৈড়েছে ভালো/ গলায় দেয় নাই চাপকলি’। যাদের ভাদুর সমালোচনা করা হয়, তারাই বা ছাড়বেন কেন, ‘তোদের ভাদু পৈরতে খুঁজে/ নূতন ছকের কাল্লাফুল/ হাতে নাই পুরাণ সিকি/ এত কিসের সাধ লো তুর’। এ ভাবে গানের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই কেটে যায় ‘ভাদু জাগরণের’ রাত। সারা রাত জেগে থাকে গ্রাম। পরের সকালে সমবেত ভাবেই মাথায় নিয়ে কোনও জলাশয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় ভাদুকে।

ভাদুর বিসর্জনের সময় সকলে বিষাদের সুরে গেয়ে ওঠেন, ‘ভাদু বিদায় দিতে/ প্রাণ আমাদের চাইছে না কোন মতে/ ভাদু বিদায় দিতে’। কিন্তু উপায় তো নেই, বিবাহের পরে যেমন ঘরের মেয়েকে বিদায় দিতেই হয়— সকলে গেয়ে ওঠেন, ‘ওরে মাধুরী, শুধু শুধু বসলি কেন ভাবিতে/ ভাদু যাবেক শ্বশুরবাড়ি-সাজাও গো কোন মতে/ ভাদু বিদায় দিতে’।

তবে বর্তমান টিভি সিরিয়াল আর মোবাইলের যুগে দিন দিন কেমন যেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে ভাদু পুজো। বাঁকুড়ার ইঁদপুর ব্লকের খ্যাতনামা মৃৎশিল্পী আলোক দাসের কথায়, ‘‘একটা সময় ছিল, আমার কাছে ৮০-১০০ ভাদু মূর্তির বায়না হত। বায়না বাদ দিয়েও কিছু অতিরিক্ত ভাদু মূর্তি বানিয়ে রাখতাম, ভাদু পূজার আগের দিন বা পূজার সকালে সেগুলিও ঠিক বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু এখন সর্ব সাকুল্যে ২০টি ভাদু মূর্তি তৈরি করলেও, সবগুলি বিক্রি

হয় না।’’

এখন গ্রামেগঞ্জে ভাদুগান জানা মহিলার সংখ্যা নগণ্য। অথচ এই গানগুলি প্রায় সবই পূর্বশ্রুত। তেমন ভাবে বইয়ের আকারে সংরক্ষিত নেই বললেই চলে। আজ আমাদের ভাবার সময়। নইলে আগামী প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ ভাবে অজ্ঞাত থেকে যাবে ভাদুপুজোর মতো লোক উৎসবগুলি।

তথ্যসূত্র: রামশঙ্কর চৌধুরী রচিত গ্রন্থ ‘ভাদু ও টুসু’

(লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vadu Vadu parab
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE