Advertisement
E-Paper

ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বাইরে

বেদ-পুরাণের সঙ্গে এই পুজোর দু’একটা ক্ষীণ যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাও সত্যি। কথিত আছে, ধৌম্য মুনি দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের সাহায্য করার জন্য সূর্যের উদ্দেশে ছট পুজো করার উপদেশ দিয়েছিলেন।

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share
Save

প্রতি বছর কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরের নাগরিকরা যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে কলা ও অন্যান্য ফল নিয়ে রাস্তা দিয়ে নদী বা সমুদ্রের দিকে যেতে দেখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবেন, ছট পুজো ব্যাপারটা কী? দেওয়ালির ছ’দিন পরে এই উৎসব, এই জন্যেই এর নাম ছট, যা আসলে ষষ্ঠী-র একটি কথ্য রূপ। একে সূর্যষষ্ঠীও বলা হয়। লক্ষণীয়, এই অত্যন্ত জনপ্রিয় লোক-উৎসবটিতে কোনও পুরোহিতের দরকার হয় না, দরকার হয় না মন্দিরেরও। এই পুজোয় ব্রাহ্মণরা কিছু পেতেন না বলে তাঁরা একে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির কোনও কাহিনির সূত্র ধরে হিন্দুধর্মের মূলধারায় নিয়ে আসার কোনও চেষ্টা করেননি। আর সেই কারণেই বাইরের লোকেরা এর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন না। আজকাল অবশ্য এই পুজোর সংস্কৃতায়নের কিছু চেষ্টা হচ্ছে, পুরোহিতদেরও আবির্ভাব হয়েছে।

বেদ-পুরাণের সঙ্গে এই পুজোর দু’একটা ক্ষীণ যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাও সত্যি। কথিত আছে, ধৌম্য মুনি দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের সাহায্য করার জন্য সূর্যের উদ্দেশে ছট পুজো করার উপদেশ দিয়েছিলেন। আবার এমন কাহিনিও আছে যে, রাম-সীতা অযোধ্যায় ফিরে এসে এই সময় সূর্যের আরাধনা করেছিলেন। অধিকাংশ রামভক্ত এ পুজো করেন না বটে, তবে রামচন্দ্র হয়তো— আমাদের মতোই— স্ত্রীর কথা অমান্য করেননি! মনে রাখতে হবে, সীতা মিথিলার জনকপুরের কন্যা, এবং মিথিলা হল ছট পুজোর কেন্দ্র। এই পুজো হয় বিহার-ঝাড়খণ্ড এবং সন্নিহিত অঞ্চলে, নেপালের মধেশীয় এলাকায়, তার সঙ্গে সঙ্গে সুদূর ফিজি, মরিশাস এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এ— বিহারের মানুষ যেখানে যেখানে বসতি করেছেন।

কার্তিক অমাবস্যায় ভারতীয়রা অন্ধকার দূর করতে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালান। বলা হয়, কার্তিক অমাবস্যা নাকি বছরের অন্ধকারতম রাত্রি। আমার মতে, এই অন্ধকারতম রাত্রির পরে ছট-ই হল উজ্জ্বল আলো আর সূর্যকে উপাসনার প্রথম উৎসব। বাঙালিদের ক্ষেত্রে যদিও ব্যাপারটা উলটো। এই সময়েই তাঁরা মা কালী এবং তাঁর চেলাচামুণ্ডাদের পুজো করে যেন অমাবস্যাকে স্বাগত জানান।

ছট পুজো মূলত মহিলাদের পুজো ছিল। এর মাধ্যমে তাঁরা সূর্যদেবতাকে তাঁর দয়া ও উদারতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে থাকেন। মজার কথা হল, পরে পুরুষেরাও এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরাও এই সময়ে ‘ছট্টি মাইয়া’ নামে এক দেবীর পুজো করে থাকেন। গুরুত্বের দিক থেকে তিনিও কোনও অংশে কম নন। আশীর্বাদ প্রার্থনায় তাঁর পুজো করা হয়। বৈদিক যুগে প্রত্যুষের দেবী উষা-র সঙ্গে এই ছট্টি মাইয়া-র সাদৃশ্য রয়েছে। যদিও এ কথা অনেকেরই জানা যে বেদ যাঁরা বহন করে এনেছিলেন, তাঁদের হাজার বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল বিহার নামক অঞ্চলটিতে পৌঁছতে। ছট পুজোর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, এখানে ভোর এবং সন্ধে, অর্থাৎ উদীয়মান সূর্য এবং অস্তগামী সূর্য— দুই-ই পূজিত হন। ছট মূলত চার দিনের পুজো। কার্তিক অমাবস্যা তিথির পর, চান্দ্র মাসের চতুর্থ দিন অর্থাৎ ‘চতুর্থী’তে শুরু হয়ে পঞ্চমী, ষষ্ঠী (এই ‘ষষ্ঠী’ শব্দটা থেকেই ছট এসেছে) পেরিয়ে শেষ হয় সপ্তমীতে। মানুষ রঙিন জামাকাপড় পরেন, নাচে গানে বিশেষত লোকসংগীতে মেতে পুজোর দিনগুলি উদ‌্‌যাপন করে থাকেন। সুদূর মরিশাস-এও রীতিমত ধুমধামের সঙ্গে এই পুজো হয়। বিহার থেকে যে শ্রমিকেরা এক সময়ে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের সূত্রেই সে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এই পুজো ওতপ্রোত মিশে গিয়েছে। যেহেতু পুজোয় সারাদিন উপবাস আবশ্যিক, তাই পুজোর আচারাদি শুরুর আগে নতুন চালের ভাত, পুরি, কলা, নারকেল, আঙুর খাওয়া হয়।

পুজোর প্রথম দিনটি ‘নহায় খায়’ নামে জনপ্রিয়। এই দিনেই গঙ্গায় পুণ্যস্নানের রীতি। মহিলারা, যাঁরা এই পুজো করেন, সারা দিনে এক বারই খান। খাবার বলতে ভাত ও লাউ সেদ্ধ। মহিলারা কোমর কিংবা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন। তার পরে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে বিবাহিত মহিলারা একে অপরের কপাল থেকে নাসাগ্র অবধি গেরুয়া রঙের সিঁদুর লেপে দেন। বিজয়া-দশমীতে বাঙালি মহিলাদের সিঁদুরখেলার রীতি সম্ভবত ছট পুজো থেকেই এসেছে। যতই হোক, সর্বজনীন দুর্গাপুজো তো বেশি দিনের নয়, বড়জোর একশো বছর পুরনো।

পুজোর দ্বিতীয় দিনকে বলে ‘খর্না’। এ দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাসে থাকতে হয়। সূর্যাস্তের পরে সূর্যদেবতাকে নৈবেদ্য অর্পণ করে তবেই ভক্তরা কিছু মুখে দেন। পায়েস বা ক্ষীর, পুরি, আটা দিয়ে তৈরি ‘ঠেকুয়া’ ও কলা বিতরণ করা হয়। পুজোর মূল দিনটি হল তৃতীয় দিন— ছট। এই দিনেও নির্জলা উপোস করার পরে সন্ধেবেলায় সূর্যদেবতাকে সান্ধ্য অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। কুলোয় ঠেকুয়া, নারকেল, কলার ছড়া এবং অন্যান্য ফলমূল সাজিয়ে সূর্যের আরাধনা করেন মানুষ। তার পরে বাড়িতে ‘কোসি’ অনুষ্ঠান হয় যেখানে দেবতার উদ্দেশে প্রদীপ জ্বালানো হয় বটে, কিন্তু তা ঢেকে রাখা হয় পাঁচটি বেতের কাঠি দিয়ে। চতুর্থ ও শেষ দিনটিকেই পবিত্রতম হিসেবে মনে করা হয়। ওই দিন ভক্তরা সপরিবার দলে দলে নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে উদীয়মান সূর্যকে তাঁদের অর্ঘ্য উৎসর্গ করেন। তার পরে মুখে চিনি ও আদা দিয়ে উপবাস ভাঙা হয়। পুজো শেষ হয়। মানুষের হর্ষধ্বনিতে ভরে ওঠে চারিদিক।

এই পুজো করে লাভ কী হয়? অনেকের মতে, এটি আসলে উর্বরতার সাধনা— জমির উর্বরতা, মানুষেরও। অন্যরা মনে করেন, নীরোগ থাকার উদ্দেশ্যে ছট পুজো করা হয়। আর একটি তত্ত্বও শোনা যায়— মুনিঋষিরা নাকি উপবাসী শরীরে সরাসরি সূর্যের আলো গ্রহণ করে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে নিতেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করা দরকার। অন্য অনেক পুজোয় নানা রাসায়নিক উপকরণ বা বিস্ফোরক ব্যবহার করে পরিবেশের ক্ষতি করা হয়, ছট পুজোয় কিন্তু কেবল এমন উপকরণই কাজে লাগানো হয় যেগুলি বায়ো-ডিগ্রেডেবল, অর্থাৎ জৈবপ্রকৃতিতে মিশে যায়। ঘটনা হল, ভারতের প্রত্যেক অঞ্চলের পরিবেশ এবং আঞ্চলিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করার স্বাধীনতা রয়েছে। প্রত্যেকেই সারা বছর ধরে নানা রকম উৎসব পালন করে, যা সারা ভারতেই পালন করা হয়। কিন্তু প্রত্যেক অঞ্চল নিজস্ব একটি বড় উৎসব বেছে নেয় যা তাদের একান্ত আপন, যা তাদের অন্য অ়ঞ্চলের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। এই ‘বিহারি’ উৎসব তাঁদের লোক-সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু এ জন্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তাদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এই উৎসব আমাদের একটা কথা মনে করিয়ে দেয়— বহু সংস্কৃতির সমন্বয়ে তৈরি এই হিন্দু ধর্ম সব সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে কতখানি নিহিত রাখতে পারে।

Chhat Puja priest Temple Bihar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy