Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ভালবাসার ধন

চিকিৎসক, স্পিচ থেরাপিস্টরা জানাইতেছেন, অধিকাংশ শিশুরই কোনও সমস্যা নাই, তাহারা কথা বলিতেছে না, কারণ তাহাদের সহিত কথা বলিবার কেহ নাই। মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেট বিনোদন দিতে জানে।

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সেই কুরুক্ষেত্রও নাই, সেই কৃষ্ণার্জুনও নাই। বিশ্বরূপ দর্শনের জন্য এখন আর বিশেষ ঝামেলা না করিলেও চলে। হাতে একটি মোবাইল ফোন ধরাইয়া দিলেই, ব্যস। সন্তান নিজেই খুঁজিয়া লইবে আনন্দের রসদ, জীবনের রূপ-গুণ-মাধুর্য। ব্যস্ত মা-বাবা নিজেদের ব্যস্ততায় (অথবা মোবাইল ফোনে) নিমজ্জিত থাকিতে পারিবেন কোনও অপরাধবোধ ছাড়াই। সন্তানের সময়ের দাবি মিটাইতেছে প্রযুক্তি— একবিংশ শতকে তো এমনটাই হওয়ার ছিল? হয়তো। কিন্তু, তাহাতে জন্ম লইতেছে এক নূতন ‘মহামারি’। স্বাভাবিক বয়ঃক্রম পার হইয়া যাইবার পরও বহু শিশুই কথা বলিতে শিখিতেছে না। চিকিৎসক, স্পিচ থেরাপিস্টরা জানাইতেছেন, অধিকাংশ শিশুরই কোনও সমস্যা নাই, তাহারা কথা বলিতেছে না, কারণ তাহাদের সহিত কথা বলিবার কেহ নাই। মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেট বিনোদন দিতে জানে। এক কার্টুন হইতে অন্য কার্টুনে প্রবাহিত হইতে জানে শিশুর অঙ্গুলিনির্দেশে। কিন্তু, সেই যন্ত্র মানবিক আদানপ্রদান শিখে নাই এখনও। শিশুর চোখের দিকে তাকাইয়া কথা বলা, তাহার কথায় উত্তর দেওয়া, হাসিয়া উঠা, মহাশক্তিমান মোবাইল ফোনও এই কাজগুলিতে অক্ষম। কারণ, সে মানুষ নহে, যন্ত্রমাত্র। একটি শিশুকে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক জীব হিসাবে গড়িয়া তুলিতে যে মানবিক সান্নিধ্য প্রয়োজন, চিন্তা অপেক্ষা দ্রুতগামী মোবাইল প্রযুক্তিও তাহা দিতে পারে না। অচিরেই হয়তো কোনও পরিষেবা সংস্থা আগাইয়া আসিবে। সন্তানকে সান্নিধ্য দেওয়ার পরিষেবাও বিক্রয় হইবে বাজারদরে। কিন্তু, যত দিন তাহা না হয়?

অধিকাংশ মানবশিশুই শিখিবার ক্ষমতা লইয়া জন্মায়। শব্দ শুনিয়া ভাষা শেখে, পারিপার্শ্বিক দেখিয়া শেখে সামাজিক নিয়মকানুন। কিন্তু, শিখিয়া লইবার জন্য তাহাদের এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন, যেখানে মানুষে-মানুষে আদানপ্রদান ঘটে। মাত্র কিছু বৎসর পূর্বেও এই পরিবেশ এমনই জলহাওয়ার মতো স্বাভাবিক ছিল যে আলাদা ভাবে তাহার উল্লেখ ছিল নিতান্তই বাহুল্য। সেই পরিবেশটিকে সরাইয়া লইলে কী হয়, কথা বলিতে না শিখিতে পারা শিশুগুলি তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে তাহাদের বেশির ভাগই স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এবং সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ হইয়া উঠিবে। শিশুর মা-বাবারা বিচারবোধসম্পন্ন ব্যক্তি-মানুষ। নিজেদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার কী, তাঁহারা নিশ্চয় জানিবেন। তাঁহারা যদি বোধ করেন যে সন্তানকে দেওয়া অপেক্ষা উপযুক্ততর ব্যবহার তাঁহাদের সময়ের আছে, তবে কি তাঁহাদের সন্তানকে সময় দিতে বাধ্য করা যায়? বিশেষত, বহু মা-বাবাই বলিবেন, পেশাদারি ক্ষেত্রে সময়ের দাবি এমনই বিপুল যে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করিবার জন্যই তাঁহাদের উদয়াস্ত খাটিতে হয়। সন্তানকে দেওয়ার মতো সময় তাঁহাদের আর থাকে না। আইনগত ভাবে তাঁহাদের সন্তানকে সময় দিতে বাধ্য করিবার প্রশ্নই নাই। সমাজও মুখ ফিরাইয়া থাকিতে পারিত, কিন্তু অ-সামাজিক ভাবে বাড়িয়া উঠা শিশু সমাজের পক্ষেও সুসংবাদ নহে। কাজেই, সময়-কুণ্ঠ মা-বাবাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, সন্তানধারণের সিদ্ধান্তটি যখন সচেতন ছিল, তখন তাহার সম্পূর্ণ দায় না লইয়া তাঁহাদের উপায় নাই। যাঁহাদের সময় কম, বা অগ্রাধিকার ভিন্ন, সন্তানধারণের পূর্বে তাঁহারা কথাটি বিবেচনা করিয়া লইবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Mobile Speech Doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE