আগ্রাসনে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান যদি হত, তা হলে ‘আগ্রাসনবাদ’ নামে কোনও একটি মতবাদের জন্ম হয়ে যেত এত দিনে, সে মতবাদের গ্রন্থরূপটি দেশে দেশে-দিশে দিশে সিংহাসনে স্থাপিত হত, সকাল-সন্ধ্যা পূজিতও হত। কিন্তু সভ্যতার পত্তন থেকে এ পর্যন্ত বার বার প্রমাণিত হয়েছে, আগ্রাসন সব সময়ই সমস্যা বাড়ায়, কমায় না। চিন দেশ সে সত্য সম্ভবত এখনও অনুধাবন করতে পারেনি। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাবতীয় কূটনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা জলাঞ্জলি দিয়েছে তারা, নিজেদের মুখটা আয়নায় দেখতেও ভুলে গিয়েছে।
শীর্ষ তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামা প্রায় ছয় দশক ভারতের বাসিন্দা। ভারতের মধ্যে তিনি কোথায় যাবেন, কখন যাবেন, কী করবেন— এ সব নির্ধারণের অধিকার শুধু ভারতের এবং দলাই লামার নিজের। গোটা পৃথিবী মানে সে কথা। চিন মানে না। চিনের দাবি— দলাই লামা সাধু নন, ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অরুণাচল প্রদেশ ভারতের নয়, তিব্বতের তথা চিনের।
বলাই বাহুল্য, চিনা কটূ-কাটব্যে ভারত গুরুত্ব দেয় না আজকাল। বেজিং কখনও বলে লাদাখের পূর্ব সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করা যাবে না, কখনও বলে অরুণাচলে রেললাইন পাতা যাবে না, কখনও বলে উত্তর-পূর্ব ভারতে সামরিক পরিকাঠামো বৃদ্ধি করা যাবে না, কখনও বলে দলাই লামাকে তাওয়াং যেতে দেওয়া চলবে না। কোনও দাবিই মানেনি ভারত। কিন্তু হট্টগোল খুব বেশি হলে, আর কিছু না হোক, বিরক্তি উৎপন্ন হয়। ভারত সেই বিরক্তিরই শিকার হচ্ছে এবং কঠোর শব্দমালায় চিনকে তাদের এক্তিয়ারটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। গোটা ঘটনাপ্রবাহে চিনের কূটনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার অভাব বেশ প্রকট।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে জম্মু-কাশ্মীরের আকসাই চিন অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়েছিল বেজিং। আজও সে অঞ্চল তারা দখল করে রেখেছে। ১৯৪৭ সালে গিলগিট-বাল্টিস্তানকে অবৈধ ভাবে দখলে নিয়েছিল পাকিস্তান। ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও সেই গিলগিট-বাল্টিস্তানের মধ্যে দিয়ে চিন অর্থনৈতিক করিডর বানিয়েছে। তিব্বতের স্বাধীনতাকামীরা দীর্ঘ দিন ধরে বেজিং-এর নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করছেন এবং স্বাধীন, সার্বভৌম তিব্বত চাইছেন। চিন অপরিসীম বলপ্রয়োগে সে আন্দোলন পিষে দিচ্ছে। চিনের এমন কোনও প্রতিবেশী দেশ নেই, যে দেশের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে তার বিরোধ নেই। এ হেন চিন ভারতকে সংযম দেখানোর পরামর্শ দিচ্ছে। আগ্রাসন দেখালে সীমান্তে সমস্যা আরও বাড়বে বলে চিন হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। বেজিং-এ যে আয়নার অভাব রয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধে চিন অসংযম এবং আগ্রাসী মনোভাবের অভিযোগ তোলার পর তা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
গোটা বিশ্বে প্রভূত্ব চায় চিন। কিন্তু আঞ্চলিক মঞ্চেই চ্যালেঞ্জের মুখে তারা। দক্ষিণ এশিয়া থেকেই আর এক বৃহৎ শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমশ প্রভাব বাড়াচ্ছে ভারত। সে প্রভাব খর্ব করতেই যে চিন অতি-আগ্রাসী, তা বেশ স্পষ্ট আজ। তাতে সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না। কিন্তু চিনের সামনে অন্য উপায়ও নেই। নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে দমাতে চিরকাল আগ্রাসনের নীতি প্রয়োগ করতেই অভ্যস্ত চিনা নেতারা। ভারতকে রুখতে তাই আগ্রাসন ছাড়া অন্য কোনও নীতি প্রয়োগের কথা ভেবে উঠতেই পারছেন না বেজিং-এর কর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy