Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে, এটা তো প্রধানমন্ত্রীও জানেন

কী করতে পারেন মোদী

একটা সময় ছিল, যখন দিল্লিতে সংবাদপত্রের অফিসে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতারা আসতেন। সাংবাদিকরাও পার্টি অফিসে যেতেন। আড্ডা হত চা-মুড়ি সহযোগে। রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকের সম্পর্কটা পেশাগত ভাবে প্রায় খাদ্যখাদকের।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০০:১৪
Share: Save:

একটা সময় ছিল, যখন দিল্লিতে সংবাদপত্রের অফিসে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতারা আসতেন। সাংবাদিকরাও পার্টি অফিসে যেতেন। আড্ডা হত চা-মুড়ি সহযোগে। রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকের সম্পর্কটা পেশাগত ভাবে প্রায় খাদ্যখাদকের। নেতাদের কাজের যুক্তি-সহ সমালোচনাই সাংবাদিকের কাজ। আমরা কোনও নেতারই জনসংযোগ অধিকর্তা নই। অবশ্য রাজনীতি ও সাংবাদিকতা দু’টি ক্ষেত্রেই এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। এখন টুইটার, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া, গুগল-নির্ভরতা বেড়েছে।

এ হেন পটভূমিতে সে দিন আমাদের দিল্লি অফিসে এসে হাজির বিজেপির এক শীর্ষ নেতা। তর্কবিতর্ক হল প্রায় দু’ঘণ্টা। নেতার প্রশ্ন ছিল, ‘‘আপনি এত অ্যান্টি-মোদী হয়ে উঠেছেন কেন?’’ বললাম, কারও প্রো বা অ্যান্টি হতে চাই না। ২০১৪ সালে যখন গোটা দেশ জুড়ে মোদী-ঝড়, তখন তো বার বার লিখেছি, ভারতবাসী মনে করছেন, এক সুপারম্যান আকাশ থেকে ভূমিতলে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রত্যাশা গগনচুম্বী। চার বছর পর ভারতের কোটি কোটি মানুষের মতো আমারও মোহভঙ্গ। চাকরি কোথায়? বিদেশি বিনিয়োগ কই? দেশ জুড়ে প্রবল ক্ষোভ। অসন্তোষ। বিদ্রোহ। তাই মোহভঙ্গ হয়ে আজ লিখছি, ঠিক যা মনে হচ্ছে।

ওই নেতা বললেন, ‘‘জেনে রাখুন, এখানে বসে যা মনে হচ্ছে, গোটা দেশের মানুষের মনোভাব কিন্তু তা নয়। আমি আপনাকে সই করে লিখে দিয়ে যাচ্ছি, ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদীই আবার ক্ষমতাসীন হতে চলেছেন। শুধু তা-ই নয়, গত বার ২৮২ হয়েছিল, এ বার হয়তো তার চেয়েও বেশি হবে।’’

নেতাটির নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কিন্তু এই কথোপকথন থেকে আপনারা দিল্লি রাজনীতির হাল-হকিকত জানবেন সরাসরি। নেতাটির নাম মনে করুন, শ্রীবিজেপি।

শ্রীবিজেপি: সব বিরোধী নেতা মিলে জোট করছেন, আর নরেন্দ্র মোদী ২০১৯-এ পরাজয় স্বীকার করে মনের দুঃখে একা ঘরের কোণে বসে মিষ্টি খাচ্ছেন, এটা ভাববেন না। তিনিও পাল্টা কিছু রণকৌশল রচনা তো করছেন রে বাবা!

আমি: পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ? অন্তত আর একটা বড় ধরনের সার্জিকাল স্ট্রাইক?

শ্রীবিজেপি: পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। দেশের মানুষ মনে করেন এটা মোদীই পারবেন। সেই সাতচল্লিশ সাল থেকে কত বছর দেশ শাসন করেছেন গাঁধী পরিবার। পাকিস্তান-কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি কেন?

আমি: নেহরু ১৯৪৭ সালের পর মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে লেখা চিঠিতে বার বার পাকিস্তানের কথা বলেছেন। ১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারির চিঠিতে বলেছেন, পাকিস্তানকে অনুরোধ জানাচ্ছি যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য, যাতে সীমান্ত বিতর্কের ফলে দু’দেশ যুদ্ধে যেন না যায়। যুদ্ধ সমাধান নয়। শান্তির পথেই এগোতে হবে। নেহরু কি ভুল?

শ্রীবিজেপি: মোদীজি তো শান্তিই চেয়েছিলেন। নওয়াজ়কে ডাকলেন, তাঁর বাড়িও গেলেন। কোথায় শান্তি! পাকিস্তান যদি কথা না শোনে, শান্তি না চায়, তবে যুদ্ধ না করাটা ভীরুতা।

আমি: যুদ্ধ? যুদ্ধ কোথায়? কাশ্মীরই বলুন আর পাকিস্তান, আপনাদের নীতিটাই বা কী? হুরিয়তদের সঙ্গে আজ কথা বলছেন, মেহবুবার সঙ্গে সরকার গড়ছেন তো সরকার ফেলে রাজ্যপালের শাসন করছেন পরের দিন। আর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ? দুই দেশের প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান তো বলেছেন, এ সব সার্জিকাল স্ট্রাইক হল ক্যালাইডোস্কোপিক যুদ্ধ।

শ্রীবিজেপি: পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা যাবে না। সংঘাতের পথে যেতে হবে। হয়তো এই শীতেই।

আমি: উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণও কি এই শীতেই শুরু হবে?

শ্রীবিজেপি: গায়ের জোরে নয়, আদালতের মাধ্যমেই এ কাজে যেতে চাইছি। শুনানি চলছে।

আমি: সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেবে তা তো আগাম বলা যায় না। তবে বোঝা যাচ্ছে আপনারা আশাবাদী। উত্তরপ্রদেশে গত নির্বাচনে বিজেপি ৮০-র মধ্যে ৭১ আসন পেয়েছিল। রাজ্যে যোগী সরকারের কাছেও উন্নয়ন কর্মসংস্থান কিছুই মিলছে না। অখিলেশ-মায়াবতী-কংগ্রেস জোট হলে ধর্মীয় মেরুকরণ ছাড়া অন্য কৌশল থাকতেই পারে না। শুধু উত্তরপ্রদেশ না, আপনারা তো ভাবছেন রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ সর্বত্র আবার জয় শ্রীরাম রাজনীতি করে ভোটারকে হিন্দুত্ব-আবেগে উদ্বেল করে তুলতে হবে। ভুল বলছি, স্যর?

শ্রীবিজেপি: হিন্দুত্ব মানেই সাম্প্রদায়িকতা? মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে ‘হিন্দুত্ব’ হল দেশের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রবাদ। আমরা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে নই।

আমি: এ তো তত্ত্বকথা। আপনারা অনেক বই ছেপে হিন্দুত্বের দর্শন বোঝাচ্ছেন। কিন্তু ভোটের আগেই বিশেষত হিন্দি বলয়ে ছোট ছোট দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় কেন বলতে পারেন? ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগর, ২০১৫ সালে দাদরি। এ বার আপনারা আবার সেই মেরুকরণ রাজনীতি করতে যাচ্ছেন। আপনাদের কোর ইস্যু।

শ্রীবিজেপি: আপনি বাম-লিবারালদের মতো বলছেন। বিজেপি সাম্প্রদায়িক হলে নির্বাচন কমিশন তাকে বৈধতা দেয় কেন? মানুষই বা আমাদের এত ভোট কেন দিচ্ছে? ভোটাররা সাম্প্রদায়িক? শুধু আপনারা ধর্মনিরপেক্ষ? (উত্তেজিত)

আমি: মবোক্রেসি তো সত্য ঘটনা। গণতন্ত্রের নামাবলি জড়িয়ে অন্যায় নানা দেশে বার বার বৈধতা পেয়েছে। ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন যদি বলেন সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে তবে কি তা সত্য হয়ে যায়? ভোটে জেতার জন্য আপনারা একটাই কাজ করছেন, তা নয়। অনেক কিছু এক সঙ্গে করছেন। দাউদ ইব্রাহিমকে আনার চেষ্টা করছেন। চার বছর পর গরিব চাষির বন্ধু হতে চাইছেন। দলিতদের জন্য বড় কিছু ঘোষণা হতে পারে ১৫ অগস্ট লালকেল্লায়। নরেন্দ্র মোদী বলছেন, তিনি একটাই কথা জানেন, বিকাশ। এ দিকে প্রবীণ তোগাড়িয়াকে সরিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদে বসেছেন মোদী-ভক্ত। আরএসএস-ও এখন মোদী-শাহের মুঠোয়।

শ্রীবিজেপি: (কথা থামিয়ে) জেতার জন্য কৌশল অন্য দলগুলি করে না? তারা ব্যর্থ, মোদী-অমিত শাহ সফল। তফাত এই। সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ নীতি। চাণক্যের কৌশল। এর জন্য তো আপনার কমপ্লিমেন্ট দেওয়া উচিত।

আমি: শাসক নেতারা সব সময়ই মনে করেন, সিংহাসন চিরস্থায়ী। গোকুলে যে প্রতিপক্ষ বাড়ে, সেটা তাঁরা সচরাচর বোঝেন না। ক্ষমতা। অহঙ্কার। তোষামোদকারীদের পদাবলি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভাবতে পারেননি নন্দীগ্রামে গুলি চলার পর ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে। বাজপেয়ী-আডবাণী ভাবেননি কংগ্রেস আবার ফিরে আসবে। আজ আপনারাও ভাবতে পারছেন না।

শ্রীবিজেপি: বিকল্পই বা কোথায়? কত জন প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী? মোদী বনাম একগুচ্ছ দাবিদার। রাহুল তো একা নন। মমতা, চন্দ্রবাবু, অখিলেশ, মায়াবতী, সবাই। মায়াবতী শেষ পর্যন্ত জোটে থাকেন কি না দেখুন।

আমি: যদি বিরোধীরা এতই অকিঞ্চিৎকর হয়, তবে আপনারা তাদের ভাঙার জন্য এত সক্রিয় কেন? আপনারা তো দেশের মানুষের ‘কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এজেন্সি’, তবু, জয় করেও ভয় যায় না কেন? মায়াবতী থেকে মমতা— সিবিআই আর এনফোর্সমেন্ট সংস্থাকে দিয়ে বিরোধী জোট ভাঙার চেষ্টা কেন? এ-ও চাণক্য নীতি?

শ্রীবিজেপি: মোদীজি আজও দেশে জনপ্রিয়তম নেতা। ২০১৯-এ তিনিই প্রধানমন্ত্রী। উত্তরপ্রদেশ ভোটের পর ভারতীয় মিডিয়া এক বার বোকা বনেছে। আপনারা আবার বোকা বনতে যাচ্ছেন।

এ ভাবেই চলল কথার পিঠে কথা। শেষে বললাম, বিজেপি জিতবে না হারবে, সে ব্যাপারে আমি কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। আমি নির্বাচনী সমীক্ষকও নই। শুধু এটুকুই বলতে পারি, গত চার বছরে এ দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন। স্তব্ধ উন্নয়ন। হিন্দুত্বের নামে চলছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা। ভোটে জেতা-হারা ভিন্ন কথা, কিন্তু এই বাস্তবকে অস্বীকার করি কী করে? শ্রীবৃদ্ধি নাকি দারুণ। কিন্তু হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের যদি আজও মঙ্গল না হয়, তবে সে কিসের গণতন্ত্র? বিজেপি নেতৃত্ব সে কথা বুঝবেন কবে? নেতাটি বলে গিয়েছেন, আবার আসবেন তর্ক করতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Amit Shah BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE