Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শাসক এবং কমিউনিস্ট

১৯৯০ সালে রুশ সুপ্রিম সোভিয়েটের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। পরের বছর ‘রাশিয়ান সোভিয়েট ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’-এর প্রেসিডেন্ট হন তিনি।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কমিউন প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন: ‘শাসকশ্রেণির কোন সভ্য পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে ও তাদের দমন করবে, তিন বা ছ’বছর অন্তর এক বার করে তা স্থির করার বদলে, সর্বজনীন ভোটাধিকার কমিউনের সংগঠিত জনগণের সেবার কাজে লাগত। যেমন মালিকের ব্যবসার জন্য মজুর, ফোরম্যান ও হিসেবনবিশ খোঁজার কাজে লাগত ব্যক্তিগত ভোটাধিকার।’ (ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ, ১৮৭১)

ভ্লাদিমির লেনিন (রাষ্ট্র ও বিপ্লব) ‘বুর্জোয়া পার্লামেন্টতন্ত্র’কে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ বলেছিলেন। তাঁর হাতেই ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রুশ সাম্রাজ্যের সংসদ ‘স্টেট ডুমা’র পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় আইনসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সুপ্রিম সোভিয়েট’। সেখানে কর্মক্ষেত্র, ব্যারাক, ডিস্ট্রিক্ট ইত্যাদি ক্ষেত্র হিসেবে জনতাকে অনেকগুলি একক-এ ভাগ করা হয়। প্রতিটি একক ভোট দিয়ে নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠান সোভিয়েট বা কাউন্সিলে। সেই সোভিয়েট তার ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, চলে তাঁদের নির্দেশে। স্থানীয় সোভিয়েট তাদের প্রতিনিধি পাঠায় উচ্চতর সোভিয়েটে। সিঁড়ি উঠে যায় সুপ্রিম সোভিয়েট অবধি। রুশ কমিউনিস্টদের মতে, এ ভাবেই একক থেকে উঠে আসা প্রতিনিধিরা মানুষের কাছাকাছি হবেন, জনতার সিদ্ধান্তকে আইনের রূপ দিতে পারবেন, প্রকৃত সর্বহারার একনায়কত্ব আসবে। সোভিয়েট সদস্যেরা শাসক শ্রেণি নন, জনতার অংশ। কমিউনিস্টদের তেমনই হওয়ার কথা।

১৯৯০ সালে রুশ সুপ্রিম সোভিয়েটের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন (ছবিতে)। পরের বছর ‘রাশিয়ান সোভিয়েট ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’-এর প্রেসিডেন্ট হন তিনি। কিছু দিনের মধ্যে ভেঙে যায় সোভিয়েট ইউনিয়ন। রুশ সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র পরিণত হয় রাশিয়ান ফেডারেশনে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট থেকে যান প্রেসিডেন্টই। প্রশ্ন ওঠে, তবে ইয়েলৎসিন কী? সোভিয়েট সদস্য হলে তাঁর সর্বহারার অংশ হওয়ারই কথা। কিন্তু তিনি অ-কমিউনিস্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও। শাসকের চূড়ামণি। সোভিয়েটের দাবি করা তৃণমূল-গণতন্ত্রের প্রতিনিধিদের প্রায় সকলেই সোভিয়েট-পতনের পরেও তখ্‌তে বা আশেপাশে রয়ে যান বহাল তবিয়তে।

বিলুপ্ত সোভিয়েট ইউনিয়নের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় রাশিয়াসহ পনেরোটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বেশির ভাগ নতুন দেশের শাসক হন সোভিয়েট আমলের নেতারাই। যেমন ইসলম কারিমভ। ১৯৯০ সালে উজবেক সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। এর পর সমাজতন্ত্র ছেঁটে ফেলে তৈরি হয়েছে রিপাবলিক অব উজবেকিস্তান। কিন্তু কারিমভ পদে ছিলেন ২০১৬ সালে মৃত্যু পর্যন্ত। যেমন হাসান হাসানভ। ১৯৯০ সালে আজারবাইজান সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। বছর দেড়েক বাদে তৈরি হয় স্বাধীন আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র। নতুন দেশে নতুন দলকে নিয়ে নতুন সরকার তৈরি করেন পুরনো হাসানভই! যেমন, আনাতোলিস গর্বুনভ্‌স। সোভিয়েট আমলে লাটভিয়ার সুপ্রিম সোভিয়েটের এই চেয়ারম্যান স্বাধীনতার পরেও হলেন সুপ্রিম কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। ২০১০ ডিসেম্বরের একটি খবরের অংশ: ‘১৯ ডিসেম্বর বেলারুসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল।... ফল সকলেরই জানা: গত ষোলো বছর ধরে দেশ চালানো প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ফের জিতবেন। বিশ্বের মিডিয়া তাঁকে নিয়ে হাসে, বলে ‘পোট্যাটো ডিক্টেটর’। কিন্তু বাস্তবটা হল, নিজের লোকেদের পণবন্দি করেছেন তিনি।’ (সেকেন্ড হ্যান্ড টাইম, স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচ) প্রসঙ্গত, আলেকসান্দর লুকাশেঙ্কো এক সময়ে কাজ করতেন সোভিয়েটের সেনাবাহিনীতে।— তালিকা চলতেই থাকবে।

এক কালে যাঁরা ছিলেন সর্বহারার নেতা, তাঁরাই ‘বাজারি’ রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে যান কী করে? ব্যাখ্যা একটাই। সোভিয়েটে যে কমিউনিস্টরা নেতার আসন অলংকৃত করতেন, তাঁরা আদৌ কমিউনিস্ট নন। তাঁরা শাসক। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে পনেরোটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয় ঠিক ছাব্বিশ বছর আগে। মস্কোর সময় ২৫ ডিসেম্বর সন্ধে ৭টা ৩২ মিনিটে ক্রেমলিন ছাড়েন মিখাইল গর্বাচভ, প্রাসাদশীর্ষ থেকে নামানো হয় কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা লাল পতাকা, ওড়ে জারের আমলের ত্রিবর্ণ ঝান্ডা। এতগুলো বছরে কী বদলাল? ২০১৫ সালে এক মার্কিনি সংস্থার সমীক্ষা বলছে, রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে রাশিয়াসহ সাতটি দেশই ‘স্বাধীন নয়’। চারটি দেশ ‘আংশিক স্বাধীন’।

একটা গল্প মনে পড়ল। ১৯৫১ সালে ভারতের ৩৯ জন সাংবাদিক, লেখক, কবি, বিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সোভিয়েট সরকার। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের অতীত কার্যকলাপ বিবেচনা করে সোভিয়েট যাওয়ার ছাড়পত্র দেয়নি সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলি। আমন্ত্রিতদের দলে ছিলেন সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারও। তাঁর কৌতুক: মস্কোর ও-পারে যদি ‘লৌহ-যবনিকা’, নয়াদিল্লির এ-পারেও ‘খাদি-যবনিকা’! আজ সোভিয়েট নেই, নিজেদের মতো করে টিকিয়ে রেখেছেন যবনিকা ভ্লাদিমির পুতিনেরা।

শাসক শাসকই। নিজের বাসস্থান হিসেবে জারদের ক্রেমলিন প্রাসাদকেই বেছে নিয়েছিলেন লেনিন। পরে জার আমলের প্রাসাদচূড়ার সোনার ইগল সরিয়ে উজ্জ্বল তারা বসিয়েছিলেন জোসেফ স্তালিন। আবার বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্টরাও থাকেন ক্রেমলিনেই। কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্ন আর ‘সিসিসিপি’ লেখা সরে বসেছে সেই পাঁচটি জোড়া ইগল।

কমিউনিস্টরা পথেই থাকেন। সোভিয়েট আমলেও লড়তেন, আজও লড়েন।

পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম আমলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংগ্রাম করেছেন যাঁরা, তাঁরা এ কথা জীবন দিয়ে জানেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Boris Yeltsin Communists Soviet Union Russia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE