প্র শ্নটা উঠেছিল বছর দুয়েক আগে উত্তরাখণ্ডে ধ্বংসলীলার পর, যা বেশ কয়েক হাজার মানুষের জীবন কেড়েছিল। এত দিনে বোধহয় প্রশ্নচিহ্নটিকে তিস্তার জলে ছুড়ে ফেলে জবাব দেওয়ার সময় হয়েছে: হ্যাঁ, দার্জিলিং উত্তরাখণ্ডের পথেই। প্রচণ্ড বৃষ্টির পর কমবেশি পঁচিশটি ভূমিধস মিরিক, কালিম্পং, কার্শিয়াং জুড়ে প্রায় চল্লিশ জনের প্রাণ নিয়েছে, অনেকে নিখোঁজ। আহত ও ঘরছাড়ার এখনও হিসাব নেই। কেউ বলতেই পারেন, এ এমন নতুন কথা কি? দার্জিলিঙে ধস তো আবহমান কাল ধরে হয়। হ্যাঁ হয়। ধসপ্রবণ বহু অঞ্চলেই হয়। কিন্তু সম্ভবত আর কোথাও রাজনীতিকরা এ ভাবে কোমর বেঁধে আশঙ্কাকে বিপর্যয় বানাতে (পরোক্ষে হলেও) নামেন না।
মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিঙে বিপর্যয়ের কথা জেনেই দৌড়ে গেছেন, পৌঁছে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর দূত এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরাও ক্ষতিপূরণের প্রতিযোগিতা করেছেন। কিন্তু দার্জিলিং ধ্বংস করার কি কোনও ক্ষতিপূরণ হয়? আজকের মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন রাজ্যে এক বন্যার প্রসঙ্গে ‘ম্যান মেড ডিজাস্টার’ শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু আজ যদি কেউ দার্জিলিঙের বিপর্যয়কে ‘পলিটিক্স মেড ডিজাস্টার’ আখ্যা দেন, তবে বোধহয় দোষ দেওয়া যাবে না। কেন, তা একটু পিছন ফিরে দেখা যাক।
বিশেষজ্ঞরা সাফ সাফ জানাচ্ছেন যে, দার্জিলিং একটা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। আজ নয়, অনেক দিন ধরেই। তার বিপন্নতা উত্তরাখণ্ডের তুলনায় কম তো নয়ই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বরং বেশি। ভূতাত্ত্বিকদের মতে দার্জিলিঙের পাহাড়ি শিলা শুধুমাত্র ভঙ্গুরই নয়, এর কাঠিন্যও বেশ কম। পাশাপাশি এ অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত অত্যন্ত বেশি, মাটির জলধারণের ক্ষমতা তুলনায় কম। ফলে নগরায়ণের জন্য উঁচু বাড়িঘর ও চওড়া রাস্তা দার্জিলিঙে কখনওই টেকসই হবে না। ভূতাত্ত্বিকদের মতে ‘দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে স্লোপ স্টেবিলিটি টেস্ট বা ঢালের স্থায়িত্ব পরীক্ষা অবশ্য প্রয়োজনীয়, পাহাড়ি এলাকায় ঢাল তিরিশ ডিগ্রির মধ্যে হলে তবেই সেখানে নির্মাণ হওয়া উচিত।’ অথচ উন্নয়নের নাম করে দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পঁয়ষট্টি ডিগ্রি খাড়াই ঢালের ওপরও বহুতল নির্মাণ চলছে। ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ আমলের ‘বিল্ডিং নর্মস ও আর্কিটেকচারাল গাইডলাইনস’, যা পাহাড়ের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমল দূরস্থান, এ শতকের গোড়ায় তৈরি সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবও ফাইলবন্দি। নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট-এর এক বিশেষজ্ঞ সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, দার্জিলিঙের প্রাথমিক পরিকল্পনা মাত্র পাঁচ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ওপর হাজার তিরিশেক মানুষের জন্য হলেও এলাকা ও মানুষ দুই-ই বেড়েছে বহু গুণ, পরিকাঠামো আদৌ পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিমালয়ান স্টাডিজ-এর গবেষণা বলছে, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও সমগ্র হিমালয়ের পাদদেশের ওপর ‘এনভায়রনমেন্টাল স্ট্রেস’ গত কয়েক দশকে বহু গুণ বেড়েছে। ১৮৭২ সালে দার্জিলিঙে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করতেন ২৯ জন, ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ৪২১, এখন পাঁচশোর আশেপাশে। এর সঙ্গে রয়েছে ক্রমবর্ধমান পর্যটকের সংখ্যা, যা গত বছর দুয়েকে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে বেড়েছে নগরায়ণের চাহিদা, বেলাগাম গাছ কাটা, রাস্তা চওড়া করার উদ্যোগ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গাড়ির চাপ, যত্রতত্র প্লাস্টিক ও নোংরার পাহাড়— যা বহু জায়গাতেই ঝোরাগুলির পথ বন্ধ করে ধসকে ত্বরান্বিত করে। বহু বিশেষজ্ঞের মতে, জলবিদ্যুতের কারণে তিস্তায় একের পর এক বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা বিপদ বাড়াচ্ছে।
এমন নয় যে কেউ কিছু জানে না। মুখ্যমন্ত্রী জিএসআইকে দিয়ে সমীক্ষা করানোর কথা বলছেন। এমন সমীক্ষা আগেই হয়েছে। এক প্রাক্তন সরকারি কর্তা বললেন, ‘জিএসআইয়ের সমীক্ষা ও পরে ইউনিসেফের এক প্রকল্পের সূত্রে নির্দিষ্ট তথ্য আছে যে, দার্জিলিঙে মোট প্রায় দু’শোটি বিপজ্জনক ধসপ্রবণ অঞ্চল আছে, কী করে ধস হওয়ার সম্ভাবনা কমানো যাবে বা ধস হলেও অঞ্চলের মানুষ কী ভাবে সামলাবেন, সে পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।’ বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট মত হল, জনঘনত্ব, নদীনালা ও ঝোরার সংখ্যা, বৃষ্টিপাত, ভূতাত্ত্বিক প্রবণতা, গাছ কাটা, ও পর্যটনের চাপের নিরিখে দার্জিলিঙে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উত্তরাখণ্ডের তুলনায় মোটেই কম নয়। ‘একমাত্র ভূকম্পন প্রবণতার প্রশ্নে দার্জিলিঙের বিপদ সামান্য কম’, মন্তব্য এক বিশেষজ্ঞের।
কয়েক দশক ধরে রাজনীতিকরা কী করছেন? ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য লড়েছেন, লড়ছেন, দার্জিলিংকে বাঁচানোর সুষ্ঠু পরিকল্পনা করেননি, বরং নিজেদের তৈরি নিয়মকেই স্বার্থের কারণে কী ভাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো যায়, তার চেষ্টা করেছেন’, স্পষ্ট মত বিশেষজ্ঞদের। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বললেন, ‘আশির দশকে যখন গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে দার্জিলিং উত্তাল, তখন সুবাস ঘিসিংকে লিখেছিলাম, আগে দার্জিলিং বাঁচান, পরে গোর্খাল্যান্ডের জন্য লড়বেন। ল্যান্ডই না থাকলে কীসের গোর্খাল্যান্ড! শহর না বাঁচলে কীসের রাজনৈতিক লড়াই! নাম পাল্টে আজ ওই চিঠি পাহাড়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নেতা-নেত্রীদের পাঠালে কম প্রাসঙ্গিক হবে না।’
যাবতীয় নেতানেত্রী অভিযোগ একবাক্যে মানছেন, কিন্তু আঙুল তুলছেন অন্যের দিকে। বাম আমলের নগরায়ণ ও পাহাড় উন্নয়ন দফতরের ভারপ্রাপ্ত ও অধুনা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের দাবি, এক সময় বাম সরকার সুবাস ঘিসিংকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে টেকসই উন্নয়নের চেষ্টা করলেও স্থানীয় রাজনীতির চাপে কিছু করে উঠতে পারেননি। এখন তৃণমূল সরকারও আঙুল তুলেছে স্থানীয় রাজনীতির দিকে। রাজ্যের এক মন্ত্রীর মন্তব্য: ‘মুখ্যমন্ত্রী বার বার আসছেন কী ভাবে দার্জিলিংকে সুষ্ঠু পরিকল্পনাসম্মত করা যায় তার দিশা দিতে, কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দল (গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা) সাহায্য না করলে কী হবে?’ বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গীরা আবার বলছেন: না অতীতে বামফ্রন্ট, না বর্তমানে তৃণমূল, দার্জিলিংকে বাঁচানোর জন্য কেউই তেমন ভাবে উদ্যোগ নেয়নি। ‘ভাবতে পারেন, দার্জিলিঙের ডিজাস্টার ম্যানেজেমেন্টের জন্য মাত্র আধ পাতা পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে!’— বক্তব্য দার্জিলিঙের বিধায়ক জিজেএম-এর ত্রিলোক দেওয়ানের। ‘আপনারা কী করেন, গোর্খা টেরিটোরিয়াল অথরিটির দায়িত্বে তো আপনারাই?’ এই প্রতিপ্রশ্নের জবাবেও দেওয়ান আঙুল দেখাচ্ছেন রাজ্য সরকারের দিকে। ‘জিটিএ-র হাতে পূর্ণ ক্ষমতা দিলে আমরা দেখিয়ে দিতাম। এখন তো একটা হেলিকপ্টার লাগলেও জেলাশাসককে বলতে হয়।’— উত্তর বিমল গুরুঙ্গের মন্ত্রীর।
দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সুইজারল্যান্ড না গোর্খাল্যান্ড, দার্জিলিঙের ভবিষ্যৎ কী, বলা কঠিন। কিন্তু রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে তা যে ক্রমেই উত্তরাখণ্ডের পথে, বা তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে, ল্যান্ডস্লাইড ল্যান্ড হতে চলেছে, তা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। গত সপ্তাহেই গোর্খে আর রাম্মাম, দুটি গ্রাম নতুন করে ধসের কবলে পড়েছে। অশনিসংকেত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy