Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ঐতিহ্য, না অধিকার

কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব দিল্লিতে বসিয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানানো সত্ত্বেও কেরল রাজ্য কংগ্রেস সেই পথে হাঁটিল না। বরং কেরলবাসীর আবেগকে কাজে লাগাইয়া নির্বাচনী ফায়দা লুটিতে কংগ্রেসই প্রথমে জন-আন্দোলনকে সমর্থন করিতে শুরু করিল।

সবরীমালা মন্দির। ফাইল চিত্র।

সবরীমালা মন্দির। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪১
Share: Save:

কোন অধিকারটির গুরুত্ব অধিক— ধর্মীয় না সংবিধানপ্রদত্ত? শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশ লইয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কেরলবাসীর পুঞ্জীভূত অসন্তোষ দেখিয়া এই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হইতে হয়। শবরীমালা মন্দিরে ধর্মের নামে দীর্ঘ দিন চলিয়া আসা এক ভয়ঙ্কর লিঙ্গবৈষম্যকে মুছিতে চাহিয়াছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত— সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার রায়ের মাধ্যমে। আদালতের ভাষায়, মহিলাদের প্রবেশাধিকার না দিবার প্রচলনটি অনৈতিক এবং সংবিধান-বিরোধী। মাননীয় বিচারপতিদের বর্ণনায়, শারীরবৃত্তীয় কারণে মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ‘অস্পৃশ্যতা’র সমতুল। এই রায়ের পর কেরলবাসীর প্রতিক্রিয়া অবশ্য বলিতেছে, আদালতের মতে তাঁহারা মত দিতে রাজি নহেন। রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন, মিছিল তো হইতেছেই, এমনকি মহিলাদের আটকাইবার জন্য পাহাড়ের নীচ হইতে মন্দিরদ্বার পর্যন্ত অগণিত ভক্তের হাজির হইবার কথাও শুনা গিয়াছে। এতগুলি মানুষের আবেগ অবজ্ঞা করিতেছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়— বিক্ষোভের মূল বক্তব্য ইহাই। ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আর্জিও করা হইয়াছে। অর্থাৎ সে রাজ্যের জনমানসে ধর্মীয় ভাবাবেগের কাছে আদালতের সাংবিধানিক বিচারের স্থানটি এখন নেহাতই গৌণ।

এই প্রতিবাদকে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। এ দেশে ধর্মীয় ঐতিহ্যে আঘাত আসিবার উপক্রম হইলে সমাজের রক্ষণশীল গোষ্ঠী প্রত্যাঘাত করিতেই অভ্যস্ত। অপ্রত্যাশিত যাহা— তাহা হইল মহিলাদের ভূমিকা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যাঁহাদের অধিকার সুরক্ষিত হইবার কথা, তাঁহারাই প্রতিবাদ আন্দোলনে সামনের সারিতে হাঁটিতেছেন। সম্ভবত পিতৃতান্ত্রিক সংস্কারের শিকল তাঁহাদের মনে এমনই বেড়ি পরাইয়াছে যে তাঁহারাও মনে করেন, তাঁহাদের উপস্থিতিতে মন্দির ও দেবতা অপবিত্র হইবেন। নারীপুরুষের সমানাধিকারের দাবি ভুলিয়া তাঁহারাও পুরোহিতবর্গের সঙ্গে গলা মিলাইতেছেন— ঋতুযোগ্য মহিলার প্রবেশসূত্রে মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ ব্রহ্মচারী আয়াপ্পার কৌমার্যব্রত ভাঙিবার প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ, বিচারবিভাগ এবং প্রশাসন তাহাদের বঞ্চনার অবসান ঘটাইতে চাহিলেও মহিলারা এই ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যকেই আঁকড়াইয়া ধরিতে চান। ত্রিভাঙ্কর দেবস্বম বোর্ড নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে, মন্দিরে মহিলাদের আটকাইবার জন্য খুব বেশি পুরুষ ভক্তের দরকার পড়িবে না!

এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইতে পারিত রাজনৈতিক দলগুলি। রায়ের সাংবিধানিক গুরুত্বটি তাহারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে পারিত। কিন্তু ভোটসর্বস্ব রাজনীতির দেশে তাহা হইবার নহে। সুতরাং এখানেও রাজনৈতিক নেতারা সস্তা জনমোহিনী অবস্থানের উপরই ভরসা রাখিলেন। ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ঘোলা জলটিতে ছিপ ফেলিতে শুরু করিলেন। উল্লেখ্য, সেই তালিকা হইতে কংগ্রেসও বাদ পড়িল না। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব দিল্লিতে বসিয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানানো সত্ত্বেও কেরল রাজ্য কংগ্রেস সেই পথে হাঁটিল না। বরং কেরলবাসীর আবেগকে কাজে লাগাইয়া নির্বাচনী ফায়দা লুটিতে কংগ্রেসই প্রথমে জন-আন্দোলনকে সমর্থন করিতে শুরু করিল। বিজেপি ও আরএসএস প্রথম দিকে নীরবতা রক্ষা করিলেও ক্রমে রায় প্রত্যাহারের দাবিতে কংগ্রেসের সঙ্গে তাহারাও পথে নামিল। কংগ্রেসের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে নিন্দনীয়। জন-ভাবাবেগের বিরুদ্ধাচরণ করিয়া সাংবিধানিক আদর্শকে তুলিয়া ধরিতেও যাঁহাদের এত জড়তা, সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে তাঁহারা কী ভাবে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করিবেন, তাহা রাহুল গাঁধীই জানেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sabrimala Temple Supreme Court Editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE