Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঘরের গঞ্জনাও তো গার্হস্থ্য হিংসা

যত বড় হয়েছি, দেখেছি ঘরের কাজের জন্য গঞ্জনা শোনা বৌদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। কত মেয়ের মুখে শুনেছি যে, কাল রান্নায় নুন একটু কম হয়েছিল বলে স্বামী থালা ছুড়ে মেরেছে।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সম্প্রতি কাগজে পড়লাম, আঠারো বছর আগে স্বামীর অত্যাচারে এক মহিলা আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারক বলেছেন— স্ত্রীকে ভাল করে রান্না করতে বলা কোনও অন্যায় নয়, এটি অত্যাচার নয়। এই রায়টির কথা পড়ে সারি সারি মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল।

সুনিপিসি (নাম পরিবর্তিত) ছিলেন ধনী বাবার আদরের বড় মেয়ে। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে তিনি যখন প্রথম স্বামীর মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি চলে আসেন, তখন তাঁর আনকোরা বিয়ে। দেহের নানা জায়গায় কালশিটে এবং ক্ষতচিহ্ন দেখে বাড়ির মহিলারা চেপে ধরেন। “কেন মারল তোকে?” “কী করেছিলি?” “বরের অবাধ্য হয়েছিলি?” (যেন বরের ‘অবাধ্য’ হলে মেয়েদের মার খাওয়া নিতান্ত ন্যায্য ব্যাপার!) সুনিপিসি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, স্বামীর মায়ের হাতের আলুর দমের মতো আলুর দম রাঁধতে পারেননি বলে তাঁর উচ্চশিক্ষিত, সে কালের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে উচ্চপদে আসীন বর তাঁকে বেধড়ক পিটিয়েছিল। বালিকা আমি সেই প্রথম শুনি যে রান্না ভাল না করলে মেয়েদের স্বামীর মার খেতে হয়।

যত বড় হয়েছি, দেখেছি ঘরের কাজের জন্য গঞ্জনা শোনা বৌদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। কত মেয়ের মুখে শুনেছি যে, কাল রান্নায় নুন একটু কম হয়েছিল বলে স্বামী থালা ছুড়ে মেরেছে। চোখের পাশে কাটা দেখে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কত মেয়ের অপ্রস্তুত উত্তর শুনেছি, “আসলে কাল একটু ভাতের তলা ধরে গিয়েছিল দিদি, ভাত বসিয়ে বাসন মাজছিলাম, আমারই দোষ। সারা দিন খেটেখুটে আসেন...’’ এই নির্যাতন আমাদের সমাজে এতইস্বাভাবিকযে বিয়ের পর মেয়েকে যেন ঘরের কাজের কারণে কথা শুনতে না হয়, সেই জন্য বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে মেয়েদের গৃহকর্মে রীতিমতো ট্রেনিং দেওয়া হয়।

শুধু পরিবার নয়, বৃহত্তর সমাজও মনে করে, মেয়েদের মূল কাজ ঘরের কাজ। পাঠ্যক্রমে ঘরের কাজের যথাযথ প্রশিক্ষণের জন্য ‘হোম সায়েন্স’ (ইদানীং ‘হোম ম্যানেজমেন্ট’) বলে আলাদা এক বিভাগ আছে। এই বিষয়ে ছেলে পড়ুয়া নিতান্ত বিরল। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে যে দেশগুলিতে পুরুষরা দিনে সব থেকে কম সময় বাড়ির কাজ করে তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম। এ দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি মেয়েরা নিয়মিত প্রতি দিন গড়ে ৩৫১.৯ মিনিট ঘরের কাজ করেন, একই বয়সি পুরুষরা সে কাজে দেন ৫১.৪ মিনিট।

মেয়েদের এই সংসারের কাজের কোনও সম্মান বা স্বীকৃতি নেই, পারিশ্রমিক তো দূর অস্ত্। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে শুনতে হয়, “সারা দিন বাড়ি বসে করো কী?” যে মেয়েরা ঘরের বাইরে মাঠেঘাটে কাজ করেন বা অফিস যান, তাঁদেরও কাজ থেকে ফিরেই হেঁশেলে ঢুকতে হয়। যে স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে আপিস থেকে ফেরেন, সেই স্ত্রীকেও বাড়ি ঢুকেই তড়িঘড়ি স্বামীর চা-জলখাবার প্রস্তুত করতে হয়। ঘরে বসে যে মেয়েরা বিড়ি বাঁধেন, চিকনের কাজ করেন বা মধ্যবিত্ত ঘরেওয়ার্ক ফ্রম হোমকরেন, সেই মেয়েদের অর্থকরী কাজের পাশাপাশিই ঘরের বেগার খাটতে হয়। এবং, এত খাটুনির পরও ঘরের কাজে পান থেকে চুন খসলে মেয়েদের কপালে জোটে মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার।

আমাদের রাষ্ট্রও মেয়েদের গার্হস্থ্য শ্রমকে যথার্থ মূল্য দেয় না। এ দেশে (উপার্জনশীল) কাজে মেয়েদের যোগদানের অনুপাত কমছে। ১৯৯৯-২০০০-এ কর্মক্ষম মেয়েদের ৩৪ শতাংশ ছিল কর্মরত। ২০১১-১২তে অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ২৭.২। এর অন্যতম কারণ মেয়েদের ঘরের কাজের চাপ। আইএলও-র একটি প্রতিবেদন অনুসারে এক বিশাল অংশের মেয়ে নিজেদেরঘরের কাজে নিযুক্তহিসেবে রিপোর্ট করেছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে এ দেশে গ্রামে ২৯ শতাংশ এবং শহরে ৪২ শতাংশ মেয়ে ঘরের কাজে নিযুক্ত হিসেবে নথিভুক্ত ছিলেন। ২০১১-১২ সালে সেই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৩৫.৩ এবং ৪৬.১ শতাংশ। এই প্রতিবেদন আরও বলছে যে, বেশির ভাগ মেয়ে বাড়িতে বসে আংশিক সময়ের কাজ করতেই আগ্রহী। গ্রামাঞ্চলে মাত্র ২১ শতাংশ এবং শহরে ২৫ শতাংশ নারী পুরো সময় বাইরের কাজে ইচ্ছুক। মেয়েরা বলেন, “আমি বেরোলে ছেলেমেয়ে সামলাবে কে, শ্বশুরশাশুড়ির সেবাযত্ন করবে কে, সংসারের কাজ কে করবে!”

এখানেই রাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রশ্ন আসে। কর্মরতা মেয়েদের সন্তানের জন্য ক্রেশের প্রকল্প আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় না। কম সময়ে কাজের জায়গায় পৌঁছনোর জন্য মেয়েরা পর্যাপ্ত পরিবহণ পান না, কাজের জায়গায় বাচ্চা নিয়ে কাজে যাওয়া এবং স্তন্যপান করানোর ব্যবস্থা থাকে না।

ঘরের কাজে পরিবারের পুরুষের ভূমিকা বাড়লে মেয়েদের কাজের বোঝা একটু কমে, তাদের পক্ষে বেরোনো সম্ভব হয়। কিন্তু রাষ্ট্র তা চায় না, কারণ আমাদের রাষ্ট্রনেতারা পিতৃতন্ত্রে বিশ্বাসী। মেয়েরা ঘরে বসে বাচ্চা দেখার দায়িত্ব নিলে, বুড়োমানুষের সেবাযত্নের দায়িত্ব নিলে, পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারের টাকা বাঁচে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণদোষের। যে ছেলে স্ত্রীকে গার্হস্থ্যকর্মে সহায়তা করে, তাকে আমাদের সমাজ বিদ্রুপ করে স্ত্রৈণ বলে। যতপ্রগতিশীলঘরানা হোক না কেন, বাড়িতে অতিথি এলে চা করতে সাধারণত মেয়েটিই আড্ডা ছেড়ে উঠে যান, পুরুষটি নয়। এমনকি বামপন্থী সভাসমিতিতেও মেয়েরাই খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে থাকেন। মিটিং শেষে মেয়েরা দৌড়ে বাড়ি ফেরেন কারণ রাতের রান্না করতে হবে, আর তাঁদের পুরুষ সহযোগীরা তখন পার্টি অফিসে গুলতানি করেন।

মেয়েরা তাঁদের মর্জি মতো সাংসারিক কাজকর্ম না করলে স্ত্রীকেশাসনকরা এ দেশে পুরুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে। ভারতে প্রতি তিন জনে এক জন মেয়ে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। এই হিংসার একটি বড় কারণ স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির মনের মতো ঘরের কাজ করতে না পারা, তাঁদের স্বাদমতো রান্না করতে না পারা। বম্বে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি তাই দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Domestic Violence Domestic Labour Patriarchy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE