Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
‘জিন সংশোধন করে মানবশিশুর জন্ম’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক

অন্তত নীতি স্থির হোক

আর ভারতে? ভাগ্যিস মেঘনাদ সাহা এখন বেঁচে নেই। থাকলে রাগে হয়তো মাথার চুল ছিঁড়তেন। এখানে দেশের সবচেয়ে বড় সম্মেলনে বসে বিজ্ঞানীরা মন্ত্রীর মুখে এই অমৃতবাণী শোনেন যে, প্রয়াত স্টিফেন হকিং নাকি বলে গিয়েছিলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কৃত আপেক্ষিকতার চেয়ে বড় তত্ত্ব বেদ খুঁজলে মিলবে, অথবা দেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন যে, কর্ণ এবং গণেশ উপাখ্যান ‘প্রমাণ’ করে, প্রাচীন ভারত জিন প্রযুক্তি ও প্লাস্টিক সার্জারি আয়ত্ত করেছিল।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

বছর কয়েক আগে ট্রেনে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে এক বামপন্থী নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নেতা সদ্য চিন সফর শেষ করেছেন। খুব খুশি। বিশেষত বেজিং শহর দেখে। রাজধানী শহরের ঠাটঠমকে নেতার চোখ ধাঁধিয়েছে বুঝলাম। বলছিলেন মাইলের পর মাইল সো-ও-জা ফ্লাইওভারগুলোর কথা। দোতলা, তিনতলা। ওই ‘সো-ও-জা’ শব্দটা বামপন্থী নেতা বেশ গর্ব ভরে উচ্চারণ করছিলেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট: দেখো, একটা কমিউনিস্ট দেশ কত উন্নতি করেছে! অনেকটা যেন ১৯৫৭ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের মহাকাশে স্পুৎনিক পাঠানো দেখিয়ে দাবি করা যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি ধনতান্ত্রিক সমাজে সম্ভব নয়, তার জন্য চাই সমাজতন্ত্র। ভারতে বামপন্থীরা অবশ্য আগে চিনের যতটা ভক্ত ছিলেন, এখন আর ততটা নন। মাও জে দং-এর পর চিন যে পথ পাল্টেছে, এখন যে বিত্তের পূজারি সে দেশ, তা মুখে স্বীকার করতে লজ্জা পেলেও, মনে মনে বুঝেছেন বাম নেতারা। মাইলের পর মাইল ‘সো-ও-জা’ ফ্লাইওভার বানাতে গেলে যে অনেক বাড়িঘর ভেঙেচুরে সাফ করে দিতে হয়, সে কথাটা বামপন্থী নেতাকে সে দিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কোনও কিছু করা মানে যদি উন্নতি বোঝায়, তা হলে ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র সে পথে এগোনোর সহায়ক বা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে। বিষয় যদি বিজ্ঞান হয়, তা হলে তার সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যক্তিবিশেষের একক প্রচেষ্টা। এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি কিন্তু অনেক সময়ই অনুক্ত থেকে যায়। এই দুই ব্যাপারের উদাহরণ মিলল সাম্প্রতিক চিন দেশে।

আর ভারতে? ভাগ্যিস মেঘনাদ সাহা এখন বেঁচে নেই। থাকলে রাগে হয়তো মাথার চুল ছিঁড়তেন। এখানে দেশের সবচেয়ে বড় সম্মেলনে বসে বিজ্ঞানীরা মন্ত্রীর মুখে এই অমৃতবাণী শোনেন যে, প্রয়াত স্টিফেন হকিং নাকি বলে গিয়েছিলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কৃত আপেক্ষিকতার চেয়ে বড় তত্ত্ব বেদ খুঁজলে মিলবে, অথবা দেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন যে, কর্ণ এবং গণেশ উপাখ্যান ‘প্রমাণ’ করে, প্রাচীন ভারত জিন প্রযুক্তি ও প্লাস্টিক সার্জারি আয়ত্ত করেছিল। সুতরাং, আমরা তো সব করেই ফেলেছি, আর কী করার বাকি আমাদের? যাদের করার অনেক কিছু বাকি, তারা সে সব কাজ করুক। আমাদের এখন বসে বসে দেখার সময়!

দেখাচ্ছে বটে চিন! নাহ‌্, মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও দেশের সাফল্যের কথা বলছি না। বলছি না চাঁদের অজানা দিকে ওদের কৃত্রিম উপগ্রহ নামানোর কথা। বলছি ও দেশের এক গবেষকের কথা। যাঁকে ঘিরে বিজ্ঞানের দুনিয়া সম্প্রতি সরগরম হল। হি জিয়ানকুই। শেনঝেন শহরে সাদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়না’র বিজ্ঞানী। গবেষণায় তাঁর বোমা ফাটানোর খবরটা প্রথম জানায় এক সংবাদ সংস্থা। ঠিক দু’দিন পরে হংকং শহরে বিজ্ঞানীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁর সাফল্যের কথা নিজেই ঘোষণা করেন হি।

কী করেছেন তিনি? সোজা কথায়, হি জন্ম দিয়েছেন প্রথম জিন-সংশোধিত মানবশিশুর। একটি নয়, দু’টি। হি-র প্রযুক্তি কৌশলের সাহায্য নিয়ে যমজ কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন এক চিনা মহিলা। এর আগে জিন-সংশোধন করে কোনও মানবশিশু প্রসব করেননি কোনও নারী (নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ভক্তেরা অবশ্যই মানবেন না এই সত্য)। প্রথম, তাই শোরগোল এই জন্মবৃত্তান্ত ঘিরে।

হি বেছে নিয়েছিলেন আট দম্পতিকে। আট পুরুষ এবং আট নারী। স্বামীরা সবাই এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস)-এ আক্রান্ত। স্ত্রীরা কেউ তা নন। এই উদ্যোগ থেকে পরে সরে দাঁড়ান এক দম্পতি। রইল বাকি সাত পুরুষ ও সাত নারী। পুরুষদের শুক্রাণু সংগ্রহ করলেন হি। সে সব চালান করলেন নারীদের ডিম্বাণুর মধ্যে। করলেন আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ডিম্বাণুর মধ্যে শুক্রাণু ঢোকানোর সময় বিশেষ এক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সংশোধন করলেন শুক্রাণুর জিন। যে হেতু পুরুষরা সবাই এইচআইভি আক্রান্ত, তাই ওঁদের শুক্রাণু এবং ওঁদের স্ত্রীদের ডিম্বাণুর মিলনে জন্মাত যে সব শিশু, তারা জন্ম গ্রহণ করত এইচআইভি নিয়ে। সেই অভিশাপ এড়াতে হি-র প্রচেষ্টা। এইচআইভি হল এমন ভাইরাস, যা ক্ষতি ডেকে আনে সিসিআর ফাইভ নামে একটি জিন-এর মধ্যে। হি চাইছিলেন ওই সিসিআর ফাইভ জিনটি সংশোধন করতে।

সেই লক্ষ্যে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে ভ্রূণ উৎপাদন। এবং শুক্রাণুর জিন সংশোধন। মোট ২২টা ভ্রূণ উৎপাদন করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে টিকেছিল ১৬টা। এর চারটি একই দম্পতির শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে উৎপন্ন ভ্রূণ। এ রকম দুটো ভ্রূণ হি রেখেছিলেন ওই দম্পতির স্ত্রীর গর্ভে। তার থেকেই যমজ সন্তান। দুই মেয়ে। তাঁর ব্যর্থতার কথাও কবুল করেছেন হি। মানবদেহের কোষে সিসিআর ফাইভ জিন থাকে দু’টি। একটা ভ্রূণে সংশোধিত হয়েছে দুটোই, আর একটিতে দু’টি জিনের একটি সংশোধিত হয়েছে, অন্যটি হয়নি। ফলে যমজ কন্যাসন্তানের এক জন এইচআইভি-র শিকার হবে না কোনও দিন, কিন্তু অন্য জনের সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না।

যে কৌশলে সিসিআর ফাইভ জিন সংশোধন করলেন হি, তার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্রিসপার’ (সিআরআইএসপিআর)। কথাটা এসেছে ‘ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট পালিনড্রম রিপিটস’ থেকে। জিন সংশোধনের লক্ষ্য যদি হয় অভীষ্ট জীব সৃষ্টি, তবে ওই প্রযুক্তি তা পাওয়ার আধুনিকতম কৌশল। এ প্রযুক্তির আবিষ্কার সাত বছর আগে।

জিন সংশোধন বা বদলের কথা যদি বলতে হয়, তবে প্রকৃতিতে ব্যাপারটা ঘটে চলেছিল কোটি কোটি বছর ধরে। পরিবেশে আপনাআপনি ঘটে চলা ওই প্রক্রিয়াটির নাম বিবর্তন। চালর্স ডারউইন যা টের পেয়েছিলেন। প্রক্রিয়াটি যেন লাগে তুক, না লাগে তাক। জীবের পিলপিল করে বংশবৃদ্ধি। তার পর প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খেয়ে বাঁচা, নয় মরা। ব্যস। ব্যাপারটা ‌র‌্যান্ডম। এলোপাথাড়ি। ওই বিবর্তন প্রক্রিয়ার হাল ধরায় মানুষের প্রবেশ ঘটে দশ হাজার বছর আগে— কৃষিকাজের প্রবর্তনে। শুরু হয় তার ইচ্ছেমতো শস্য বা প্রাণী প্রজনন। সে প্রক্রিয়াও ছিল র‌্যান্ডম, এটার সঙ্গে ওটা মিশিয়ে দেখা যে কী পাওয়া যায়। ইচ্ছেমতো জীব পাওয়ার উন্নত পদ্ধতি জিন সংশোধন। ক্রিসপার প্রযুক্তি সে কাজের সেরা উপায়। এ প্রযুক্তির সাহায্যে ইতিমধ্যেই যেমন মিলেছে উন্নত চাল, সয়াবিন কিংবা টম্যাটো, তেমনই পাওয়া গিয়েছে আর্নল্ড শোয়ার্ৎজ়েনেগার-সুলভ পেশিবহুল কুকুর, বেড়ালের সাইজ়ের পোষ্য শুয়োর কিংবা এমন ভেড়া, যার পেশি এবং লোম (সুতরাং পশম ও মাংস) দুটোই বেশি। কিন্তু মানুষ? তার বেলায় ক্রিসপার প্রযুক্তি মারফত জিন সংশোধন করে শিশু উৎপাদন আগে কখনও হয়নি। তাই হি-র কাজ ঘিরে উঠছে অনেক প্রশ্ন। প্রথমে সন্দেহ! হি কি সত্যিই জিন সংশোধন করেছেন নবজাতকের, না কি তাঁর দাবি মিথ্যে? হি এ বার তদন্তের সম্মুখীন। যদিও হংকংয়ে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে হাজির বিজ্ঞানীরা প্রায় সবাই মেনে নিয়েছেন— তাঁর দাবি ঠিক, নিজের কাজ সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেননি তিনি।

এ বার অন্য সব প্রশ্ন। নীতির। যে দম্পতির যমজ কন্যাসন্তান হল, হি কি তাঁদের আগেভাগে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর পরীক্ষায় গিনিপিগ হতে চলেছে ওই নবজাতকরা? কোন পরিস্থিতিতে এক দম্পতি নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন হি-র পরীক্ষা থেকে? জন্মাল যে যমজ মেয়ে দু’টি, তারা যদি বিকলাঙ্গ হয়, তা হলে পরীক্ষার দায় কার ওপর বর্তাবে? দেশেবিদেশে গবেষণারত প্রায় শ’খানেক চিনা বিজ্ঞানী হি-কে নিন্দা করে এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এ রকম পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য চিনে নির্দেশিকা আছে, কিন্তু যে নির্দেশিকা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা নেই। সে রকম শাস্তির দাবিতে এ বার অনেকে সরব। ‘আমি বিরক্ত, মর্মাহত’, বলেছেন জেনিফার ডাউডনা। বার্কলে-তে ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মহিলা গবেষক, যিনি ক্রিসপার কাজে লাগিয়ে জিন সংশোধনের কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। একটি সংযত মন্তব্য করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ চার্চ, যিনি মানুষের ক্ষেত্রে ক্রিসপার প্রযুক্তি প্রয়োগের পথ প্রশস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যমজ মেয়ে দুটো যদি সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকে, তবে আরও গবেষক এ রকম প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসবেন। এখন প্রশ্ন হল, এমন পরীক্ষানিরীক্ষা আমরা অনুমোদন করব কি না। না করলেও, এ সব চোরাগোপ্তা ভাবে হবে। সুতরাং, আমাদের ভেবে দেখতে হবে, এ ধরনের কাজকে আমরা গোপনীয়তার দিকে ঠেলে দেব কি না।’’

ঠিক কথা। মানতেই হবে, হি গবেষণার জগতে একটা আঘাত হেনেছেন। ‘অপরাধ’-এর শাস্তি হিসেবে চাকরিটিও খুইয়েছেন। ধাক্কা খেয়ে এ বার সবাই নড়েচড়ে বসেবেন। এ ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ বার রীতিনীতি নির্ধারিত হবে। যে কাজটায় দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিতর্ক বাদ দিলেও, অন্তত এই কারণে সাধুবাদ অবশ্যই পাবেন হি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gene Alteration Child Birth Technology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE