পাক সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন সিধুর। এই ছবি ঘিরেই বিতর্ক।
নভজ্যোৎ সিংহ সিধু পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়া সেখানকার সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করিয়াছেন। সুতরাং আদালতে তাঁহার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা ঠোকা হইয়াছে। এই ঘটনাপরম্পরাকে যদি কাহারও অদ্ভুত বা উদ্ভট মনে হয় তবে বুঝিতে হইবে, বর্তমান ভারতের রাজনীতির সহিত তাঁহার যথেষ্ট পরিচিতি নাই। কেননা কেবল বিহারের মুজফ্ফরপুরে সুধীরকুমার ওঝা একাই তো সিধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ লইয়া আদালতে যান নাই, দেশব্যাপী বহু মানুষ— অবশ্যই ‘জাতীয়তাবাদী’ মানুষ— মনে করিয়াছেন যে সিধুর এই অপরাধ ভয়ানক পর্যায়ের, কঠোর শাস্তিযোগ্য। সিধু শুধু পাক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াকে আলিঙ্গনই করেন নাই, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের প্রধান মাসুদ খানের পাশে বসিয়াছেনও বটে! সব মিলাইয়া এখন বিজেপির নেতা ও সমর্থকদের হাতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আর একটি মোক্ষম শাণিত অস্ত্র চলিয়া আসিয়াছে, কেননা সিধু পঞ্জাবের কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী।
বর্তমান গৈরিকরঞ্জিত জাতীয়তাবাদের চোখে পাকিস্তান শব্দটিই দূষিত এবং বিষবৎ পরিত্যাজ্য। তাহা না হইলে, সেই বিকৃত কাচটি দিয়া না দেখিলে এই ধরনের নালিশ বা আপত্তি কেবল হাস্যকর নহে, বর্বরোচিত মনে হওয়াই স্বাভাবিক। একটি সার্বভৌম দেশের রাজনীতিক অন্য একটি সার্বভৌম দেশের সেনাপ্রধানের সহিত দেখা করিলে বন্ধুত্ববাচক করমর্দন বা আলিঙ্গনই তো করিবেন, সপাট কশাঘাত তো করিবেন না! বাজওয়া যদি সিধুর দিকে সৌহার্দ্যসূচক করমর্দনের জন্য হাত বাড়ান, সিধুর কী করা উচিত ছিল? হাতটি সরাইয়া লওয়া? তাহাতেই কি গৈরিক জাতীয়তাবাদীর সঙ্কীর্ণ মন শান্ত হইত? এই অতিজাতীয়তার ধ্বজাধারীদের মনে করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, ক্ষমতায় আসিয়া প্রথম ‘আকস্মিক’ পাকিস্তান সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কী ভাবে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে আলিঙ্গন করিয়াছিলেন, তাঁহার গৃহে মিষ্টান্নগ্রহণও করিয়াছিলেন। কেন তবে তাঁহার বিরুদ্ধে তখন মামলা ঠোকেন নাই এই কলহপরায়ণ সঙ্কীর্ণমনা যুদ্ধবাদীরা? তাঁহার নাম নরেন্দ্র মোদী বলিয়া?
প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে দুষ্ট রাজনীতির স্বভাবই এই যে তাহা বাকি সমস্ত রাজনীতিকেও ক্রমে দূষিত করিতে শুরু করে। তাই বিজেপি-সঙ্ঘ পরিচালিত পাকিস্তান-বিদ্বেষনাট্যের প্রভাব পড়িতে শুরু করিয়াছে বিরোধী দল কংগ্রেসের অন্দরেও। পঞ্জাবের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংহ কোথায় দৃঢ়চিত্তে তাঁহার সরকারের মন্ত্রীর পাশে দাঁড়াইবেন, তাহা নহে, ইতিমধ্যেই তিনি ঘোষণা করিয়াছেন যে, না, তাঁহার সরকার সিধুর পাক সফর এবং তাহার বৃত্তান্তের সহিত কোনও ভাবে যুক্ত নয়। এই ভাবেই বিজেপির সঙ্কীর্ণমনস্কতা গোটা দেশের রাজনীতিকেই সঙ্কীর্ণ করিতেছে, বিজেপির দ্বিচারিতা তাহার রাজনীতিকে নীতিবোধরহিত করিতেছে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে শোকপ্রকাশের ঘনঘটার মধ্যে কেহ মনে রাখিতেছেন না যে এই বাজপেয়ীই কিন্তু বলিয়াছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সহিত যত স্বার্থবিরোধই থাকুক না কেন, তাহার জন্য দুই দেশের মধ্যে সর্বব্যাপী বৈরিতা সৃষ্টির প্রয়োজন নাই। বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্ব কালেই কার্গিল যুদ্ধ ঘটিয়াছিল, কিন্তু তাঁহার তত্ত্বাবধানেই ভারত-পাক মৈত্রীর সোপান নির্মিত হইয়াছিল, এই কথাটি ওঝাদের মনে করাইয়া দেওয়া বিজেপির উচ্চ নেতৃত্বের কাজ ছিল। তাঁহারা স্বভাবতই পরিবর্তে ওঝাদের উস্কাইবার কাজটিই পছন্দ করিতেছেন। অন্তর্দৃষ্টি কিংবা বহির্দৃষ্টি কোনওটাই না থাকিলে রাজনীতি অন্ধ হইয়া পড়ে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পদে পদে তুমুল অন্ধতার দিকে দেশকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy