গত কাল সকালে অনেক আশা নিয়ে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে সুরক্ষাজনিত কিছু বলবেন এবং এ ছাড়াও হতদরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর জন্য যথার্থ আশার বাণী শোনাবেন। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা সত্যিই হতাশ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শুনতে পেলাম না দেশের ১৩৫ কোটি মানুষকে মারণরোগ থেকে বাঁচার কোনও সুপরিকল্পিত রোড ম্যাপ বা দেশের বিজ্ঞানীদের কোভিড ১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের অগ্রগতি। সারা দেশের মানুষ আজ গভীর সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে।
মানি কিংবা না মানি, সাধারণ নাগরিক ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি না আমাদের দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হলে কী পরিস্থিতি হতে পারে! আমরা কি সেই ভয়াবহ আবস্থা মোকাবিলার জন্য যথার্থভাবে প্রস্তুত! ঠিক ভাবে কেউই জানি না এর উত্তর। চার দিকে শুধু হতাশার ছবি। দেশের অর্থনীতি তলানিতে এসে ঠেকেছে। ডাক্তার ও নার্সদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষার সামগ্রী অপ্রতুল। গরিব মানুষেরা তাঁদের বেঁচে থাকার রসদটুকু জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছেন। লকডাউনের চাপে প্রায় সকলেই হাঁসফাঁস করছেন। বিশেষ করে, ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজ্য সরকারগুলির অর্থনৈতিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। এ কথা নতুন করে বলার নয়, সকলেই জানেন বিষয়টি। এখন মূল সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে অন্য কিছু ভাবার সময় নয় বা করারও সময় নয়। কিন্তু সরকারি ভাবে তাই-ই বারবার ঘটছে। এই সঙ্কটজনক অবস্থাতেও রাজনৈতিক গিমিক চলছে অবলীলায় আর আমরা সাধারণ নাগরিকেরা বাধ্য পড়ুয়ার মতো মেনেও নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর দেশের নাগরিকদের প্রতি বার্তাতে তারই প্রতিফলন ঘটছে। ক’দিন আগেই তাঁর কথা শুনে ডাক্তার-নার্সদের সম্মান জানাতে উৎসাহী জনতা কাঁসর-ঘণ্টা-থালা বাজিয়ে ও হাততালি দিয়ে করোনা তাড়ানো উৎসব পালন করলেন! লকডাউনের নিয়মনীতি ভেঙে চুরমার করা হল। যে জনতা-জনার্দন রাস্তায় নেমে ডাক্তার, নার্সদের জন্য ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বাজি ফাটিয়ে লকডাউনের ষোলোকলা পূর্ণ করল, আবার সেই জনতা-জনার্দনের কয়েক জন এই ভয়ঙ্কর আবহের মধ্যে ডাক্তার-নার্সদের পেটাতেও পিছপা হচ্ছে না। একেই বলে ‘বাইনারি অপোজিসন’ বা ‘দ্বৈত বৈপরীত্য’। এ ধরনের ‘সার্কাস’ আমাদের দেশেই সম্ভব। ভোটের রাজনীতি বড় বালাই।
এ বার সময় এসেছে ভারতবাসীকে অখণ্ড ঐক্য দেখানোর। কেননা, প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন ৫ তারিখে অর্থাৎ রবিবার ৯ মিনিট ঘরের আলো নিভিয়ে প্রদীপ, মোমবাতি বা নিদেনপক্ষে টর্চ অথবা মোবাইল ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে আলোকবার্তা বিশ্বময় বিকিরিত করতে হবে। এই বার্তা নাগরিকদের কাছে পৌঁছতেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। এর সপক্ষে ও বিপক্ষে নানা মতামত উঠে আসছে। সামাজিক মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কথায় ও ছবিতে তীব্র কটাক্ষও দেখতে পাচ্ছি। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও। কেউ কেউ মনগড়া বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এই কার্যকলাপের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে নাকি ‘কালেকটিভ কনসাসনেস’ তৈরি হবে, বাড়বে মানসিক মনোবল। গভীর সঙ্কট মুহূর্তে মানুষকে হতাশা ভীষণ ভাবে গ্রাস করে। মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে আমার সহনাগরিকদের অবস্থাও তাই-ই। এ কথা মানতে কোনও অসুবিধা নেই নাগরিকদের মানসিক মনোবল বাড়ানো প্রয়োজন। তার মানে এই নয় যে, দেশজুড়ে গিমিক তৈরি করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে আমাদের আত্মশক্তি জাগ্রত করতে হবে। ভয়াবহ সঙ্কটমোচনের প্রাথমিক প্রয়োজন না মিটিয়ে এই বিলাসিতা আমাদের সাজে না। কেন্দ্রীয় সরকারের আশু কর্তব্য হল, যথার্থ চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রয়োজনীয় যাবতীয় পরিষেবা প্রদান করা। এখন ৯ মিনিট কেন, এক মিনিট সময়ও নষ্ট করা ঠিক নয়। শুধু ৯ মিনিট নয়, এই ‘অকাল দীপাবলি’ পালনের প্রস্তুতি অতি উৎসাহী নাগরিকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। চার দিকে প্রদীপ ও মোমবাতীর পসরা বসতে শুরু করেছে।
এর জন্য অবশ্য মৃৎশিল্পীরা ও মোমবাতি ব্যবসায়ীরা দু’টো পয়সার মুখ দেখতে পাবেন। হয়তো দেখা যাবে প্রদীপ ও মোমবাতির আকাল। আবার, কেউ কেউ ভাবছেন ৯ মিনিট আলো না জ্বালানোর জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। আচ্ছা ভাবুন তো, এখন কি বিদ্যুৎ বাচাঁনোর সময়! যেখানে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে মরণ-বাঁচনের লড়াই চলছে, সেখানে এই ধরনের ভাবনার কোনও বাস্তবিক মূল্য আছে কি! বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার অনেক সময় আমরা পাবো করোনা-উত্তর পর্বে। তখন না হয় সাশ্রয়ের উৎসব পালন করব।
আর একটি বিষয় নিয়েও খুবই আশ্চর্য লাগছে। বিষয়টি হল ‘৯’ সংখ্যা নিয়ে ঐতিহ্য আশ্রিত সংস্কারজনিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা। নিউমেরোলজির পরিধিতেও কাটাছেঁড়াও হচ্ছে। মোদ্দা কথা, এই ধরনের বিশ্বাস-সংস্কার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগত ভাবে পালিত হয়। কিন্তু সরকারি নির্দেশে বা অনুরোধে এ ধরনের বিশ্বাস-সংস্কার গোটা দেশ জুড়ে পালিত হতে পারে! এই ধরনের নজির আমাদের দেশে আছে কি না, জানা নেই। সরকার কি বিশ্বাস, সংস্কার, প্রথা এবং লোকাচারের উপরে দাঁড়িয়ে চলে, না কি পরিকল্পিত প্রকল্প প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়! ধর্মনিরপেক্ষ আচরণই সাংবিধানিক বিধিসম্মত। এ আমরা কোনও ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবছি?
এখানেই শেষ নয়। ‘লাইট’ বা ‘আলো’ বা ‘আলোকশিখা’র সামাজিক গুরুত্ব ও ধর্মীয় তাৎপর্য নিয়েও চাপানউতোর জনমানসে জোরকদমে চলছে। কয়েক জন মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী মোদি-উবাচ সমর্থনে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যা সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই চটক তৈরি করেছে। এ সবের বিপক্ষেও বলছেন অনেকেই, বুদ্ধিজীবী থেকে একেবারে খেটে খাওয়া আটপৌড়ে অতিসাধারণ মানুষ। জ্যোতিষশাস্ত্রের পরিধিতেও চর্চা কম হচ্ছেনা। এখন প্রশ্ন, করোনা-অন্ধকার দূর করতে এবং নাগরিকদের জোটবদ্ধ ও উজ্জীবিত করতে এ ছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই? না ব্যাপারটা এ রকম— ব্যক্তিজীবনে যখন দেখি গভীর সমস্যা ও বিপদ কোনও ভাবেই দূরীভূত হচ্ছে না তখন দৈব ভরসা ছাড়া উপায় থাকে না। আরও বেশি ভাবে প্রচলিত বিশ্বাস, সংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়ি আমরা? সবচেয়ে বড় কথা হল, তখন সমস্যা সামনাসামনি মোকাবিলা না করে সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিই। আমরা কি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্কল্পবার্তায় সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম? এই কথা ভেবেই সংশয় হচ্ছে এখন!
লকডাউন চলছে। তবে কিছু অসচেতন নাগরিকদের জন্য তা বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে। ‘মন মানে না’ গোছের ভাবনায় তাড়িত হয়ে অহেতুক বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন অনেকে, ছোটখাট জমায়েত করছেন। আবার প্রয়োজনেও কখনও কখনও জমায়েত হচ্ছে। পারস্পরিক দূরত্ব বজায় থাকছে না। গোদের উপরে বিষফোঁড়া করোনাভাইরাস তাড়ানো ও মনোবল বাড়ানো এবং ঐক্য প্রকাশের উৎসব পালন! অবধারিত ভাবেই এর সঙ্গে থাকবে ‘করোনা আরাধনার’ আড়ম্বর। আবারও এক বার মোমবাতি কেনার লাইন পড়বে। নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে উঠবে জনতার কিছু অংশ। মোদিজির ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কী হয়, দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy