প্রতি মুহূর্তে বাড়িতেছে কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। অথচ প্রতিষেধকের দেখা নাই। এমতাবস্থায় কেহ ভরসা রাখিতেছেন অলৌকিক শক্তির উপর, কেহ দেশজ টোটকায় নিরাময় খুঁজিতেছেন। সেই টোটকার তালিকাও দীর্ঘ এবং বিচিত্র। কেহ বলিতেছেন খর রোদে দাঁড়াইয়া ভিটামিন ডি শুষিয়া নিলে সংক্রমণ-মুক্তি সম্ভব, কেহ আবার জানাইতেছেন, এই ক্ষেত্রে রসুন অতি কার্যকর। প্রত্যহ দুই-তিন কোয়া রসুন জলযোগে খাইলে যে কোনও রোগমুক্তিই সম্ভব, কোভিড-১৯ তো বটেই। কখনও সমাজমাধ্যমে উঠিয়া আসিতেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের জাল নির্দেশিকা। তাহাতে স্পষ্ট বলা হইয়াছে, প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর জল খাইলেই সংক্রমণের বিষ দূর হইবে। কখনও শোনা যাইতেছে, ঠান্ডা নহে, উষ্ণ জলেই ভাইরাস বধ্য। তবে, টোটকা-তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানটি সম্ভবত গোমূত্রের প্রাপ্য। হিন্দু মহাসভার দাবি, নিয়মিত গোমূত্রপানই একমাত্র রুখিতে পারে এই ভয়ঙ্কর সংক্রমণ।
সুতরাং, সম্ভাব্য সমাধান বিস্তর। একমাত্র চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরাই এই কাজে ব্যস্ত হন নাই, সমাজের এক শ্রেণির মানুষও দায়িত্বসহকারে রোগমুক্তির উপায় সন্ধান এবং তাহা সমাজমাধ্যমে ছড়াইতে তৎপর। সঙ্কটকালে এই স্বঘোষিত পণ্ডিতদের কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে। করোনা-সংক্রমণের প্রেক্ষিতে ইহাদের অতিসক্রিয়তা সমাজের পক্ষে ঘোর বিপজ্জনক। চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা বারংবার সাবধান করিতেছেন, এহেন টোটকার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নাই। কিন্তু রোগভয়ে ভীত মন সেই ফাঁদেই পড়িতে চাহে। যেমন, ডেঙ্গিতে পেঁপেপাতার রস অথবা ছাগদুগ্ধপানে প্লেটলেট বৃদ্ধির কাহিনিটি রীতিমতো জনপ্রিয়। স্মরণে আসিতে পারে, পরিবারে কাহারও জলবসন্ত হইলে এক সময় পুরো পরিবার একুশ দিন আমিষ খাদ্য স্পর্শ করিত না, যাহাকে অ-বৈজ্ঞানিক বলিয়া উড়াইয়া দেন বহু চিকিৎসকই। ইহা ছিল (কু)সংস্কার। কালের নিয়মে সেই সংস্কারাচ্ছন্ন মনই বিজ্ঞানকে দূরে ঠেলিয়া অতিমারি-রোধে দেশজ টোটকায় ভরসা খুঁজিতে চাহে। সুতরাং, স্বঘোষিত সমাজসচেতক যখন নিদান দেন, মদ্যপানেই ভাইরাস মরিবে, তখন পানশালার সম্মুখে অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়। আশ্চর্য নহে!
এমতাবস্থায় প্রয়োজন স্থিতবুদ্ধির, যাহা গ্রহণীয় এবং অ-গ্রহণীয় বিষয়গুলির মধ্যে তফাত করিতে পারে। সকালে উঠিয়া ঈষদুষ্ণ জলপানে ক্ষতি নাই। কিন্তু উত্তাপে ভাইরাস মরে, এই তত্ত্বে বিশ্বাস করিতে গিয়া ফুটন্ত জল গলায় ঢালিলে সমূহ বিপদ। বিপদসঙ্কেত বুঝিবার ক্ষমতা লোপ পাইলে সর্বনাশ। ইতিমধ্যেই বঙ্গে গোমূত্র খাইয়া হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা ঘটিয়াছে। রোগ যত ছড়াইবে, এই বিপদ আরও বাড়িবে। কারণ, সমাজের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখনও প্রথাগত চিকিৎসার বাহিরের চিকিৎসায় আস্থা রাখেন। কারণ তাহা সহজলভ্য। সাধারণ অম্বলের সমস্যায় মানুষ ডাক্তারের কাছে না ছুটিয়া জামের বীজচূর্ণ খান। কৃমি দূর করিতে শিশুর মুখে কালমেঘ পাতার রস ঢালেন, লিভার ঠিক রাখিতে কাঁচা হলুদ চিবান। সকলেই যে ভুল, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কিন্তু প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের সহিত আপস চলে না। সেখানে প্রথাগত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার নিকট নত হইতেই হয়। নিজের স্বার্থে, দশের স্বার্থে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy