আগামী লোকসভা নির্বাচনে কোন দল জিতবে বা হারবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে, ভারত নামক ধারণাটারই কি অস্তিত্ব আদৌ থাকবে? সত্তর বছর ধরে নানান ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নির্মিত এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্র— সে গণতন্ত্রের যতই অপূর্ণতা থাক না কেন। আজ সেই ভারত নামক দেশ, তার আদর্শগত ভিত্তিটাই বিপন্ন। রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে তো বটেই, অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে গো-তাণ্ডবের নামে মুসলমান নিধনের উল্লাস। পাশাপাশি চলছে দলিত অবদমন, আদিবাসীদের লুণ্ঠন। হত্যাকারীরা মন্ত্রীর হাতে মালা পাচ্ছে, সাংসদ-বিধায়ক-নেতার কাছে পিঠ চাপড়ানি পাচ্ছে। পেহলু খান, রাখবার খান, রোহিত ভেমুলারা প্রতীকমাত্র। তাঁদের ওপর আক্রমণ তো আসলে ভারত নামক সেই ধারণার ওপর কুঠারাঘাত, যার প্রাণবস্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ ও মতভিন্নতার প্রতি সহিষ্ণুতা।
এই পরিস্থিতিতে যাঁদের সক্রিয়তা সব চেয়ে বেশি প্রত্যাশিত, তাঁরা হলেন বামপন্থীরা। দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার শিকড় যত মজবুত থাকে, গণতন্ত্রও সেই হিসেবে প্রসারিত হয়। আবার গণতন্ত্রের প্রসার সমানাধিকারের পূর্বশর্ত। সমাজের সব চেয়ে নিপীড়িত, অবহেলিত যে মানুষদের সহ-নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করানোর সংগ্রাম বামপন্থীদের পরিচয় গড়ে দিয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সেই লড়াইয়ের যোগই সব চেয়ে বেশি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং ফ্যাসিবাদী কর্মসূচির কারণে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত বামপন্থী রাজনীতিতে স্বাভাবিক অগ্রাধিকার পেয়েছে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী— ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ, নারী, এবং আর্থিক শ্রেণিবিভাজনে দরিদ্র। তা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বামপন্থীদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি থেকে গিয়েছে।
যেমন, ২০১৬-র পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে একটা নির্বাচনী জোট গড়ে ওঠে। বিজেপির আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতা এবং তৃণমূলের স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই জোট একটা অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যার সাহায্যে বামপন্থীরা যাদবপুরের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসন ফিরে পেয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা, বিজেপির উত্থানকে একটা সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা গিয়েছিল। এই জোটে যদি নীতির প্রশ্নটাকে আরও বড় করে তুলে আনা যেত, অর্থাৎ, মানুষের কাছে যদি এই বার্তাটা স্পষ্ট ভাবে পৌঁছে দেওয়া যেত যে এই জোট ক্ষমতা দখলের জোট নয়, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য এক আন্দোলনের সূচনা, তা হলে হয়তো নির্বাচনী ফল অনেকটাই ভাল হতে পারত।
কিন্তু, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি এই জোটের নিন্দা করল। এবং এই ভ্রান্তির পথ ধরেই এ রাজ্য থেকে সীতারাম ইয়েচুরির রাজ্যসভায় প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব বাতিল করল। এতে বৃহত্তর জোট বাধাপ্রাপ্ত হল। এই মুহূর্তে সংসদে যে বিরোধী কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দরকারি— যেটাতে সীতারাম খুবই শক্তি জোগাতে পারতেন— সেই সুযোগটা নষ্ট হল। সর্বোপরি, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসার রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হল।
তৃণমূল এ রাজ্যে যে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ সেটা চাইছেন না। আবার একক ভাবে বামপন্থীরা তৃণমূলের মোকাবিলা করতে পারবেন, এমন ভরসাও লোকে পাচ্ছেন না। তা ছাড়া, বামফ্রন্টের শেষ দিকের নানা আচরণ স্মরণে থাকায় মানুষ তাঁদের প্রতি সন্দিহান। এ কারণেই তাঁরা যখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়লেন, লোকের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটেছিল। জোট ভেঙে যাওয়ায় মানুষ নিরাশ হলেন, যার প্রতিফলন দেখা গেল পঞ্চায়েত নির্বাচনে— বামপন্থী ও কংগ্রেস, উভয়কেই সরিয়ে উঠে এল বিজেপি।
এটা ঠিক যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। সেই সঙ্গে এটাও বাস্তব যে তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন বামপন্থীরা— প্রাক্তন সাংসদ, বিধায়ক, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাই যখন মার খান, নিগৃহীত হন, তখন গ্রাম স্তরে কর্মীদের বিপদটা অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও যে সব এলাকায় সন্ত্রাস কম ছিল, সেখানেও বামপন্থীরা বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারলেন না। যেমন, জঙ্গলমহল এলাকায় তৃণমূল সরকার দরিদ্র মানুষের সহায়ক কিছু কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু এ দলের দুর্নীতি-অত্যাচার-স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে লোকে এতটাই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন যে, তাঁরা যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে সরাতে চাইলেন। সরকারে থাকাকালীন সিপিএমের কাজকর্ম, এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ার ফলে নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ফাঁক গলে বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে এল বিজেপি। এমনকি বহু বাম কর্মী-সমর্থক বিজেপিকে সমর্থন করে বসেছেন।
এটার একটা কারণ স্থানীয় রাজনীতির সমীকরণ— তৃণমূলের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচা। কিন্তু বড় কারণটি সম্ভবত সিপিএম-সহ বামপন্থী দলগুলোর বিজেপির রাজনৈতিক চরিত্রকে ঠিক ভাবে না বোঝা। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেই শিউরে উঠেছিলাম, যখন কেউ কেউ বলেছিলেন, বিজেপি আসে আসুক, তৃণমূল খতম হোক। এ বারের নির্বাচনেও শোনা গিয়েছে তৃণমূল ও বিজেপিকে একই রকম বিপদ বলে প্রচার।
যে ভ্রান্তি কংগ্রেস ও বিজেপিকে একই মাপের শত্রু বলতে শেখায়, সেই একই মতাদর্শগত পঙ্গুত্ব তৃণমূল ও বিজেপিকে সমান বিপজ্জনক বলে দেখাতে চায়। দৃষ্টিভঙ্গির এই অস্বচ্ছতা পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির পুরনো রোগ। ‘বস্তুকে তার নির্দিষ্ট অবস্থানে’ দেখার যে স্বচ্ছতা মার্ক্সবাদের অন্যতম শিক্ষা ও বৈশিষ্ট্য, ঘাটতিটা সেখানেই। এই ঘাটতি থেকে বামফ্রন্ট মণ্ডল কমিশনের বিরোধিতা করে, মুসলমানদের জন্য সমানাধিকার সৃষ্টির কোনও ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করে, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের বিরোধিতা করে, গোর্খা ও কামতাপুরিদের স্বাধিকারের আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করে।
আজকের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের স্বৈরশাসনের প্রতিরোধ অবশ্যই করতে হবে; কিন্তু একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে রাজ্যগুলোর ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামে কেরলের সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লির আপ এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একত্র হতে হলে সমস্যা কোথায়? ২০ জুলাই তৃণমূল ও সিপিএমের সদস্যদের তো এক সঙ্গে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে হল। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ও বিজেপির গণতন্ত্রবিধ্বংসী অভিযান যত তীব্রতর হচ্ছে, ততই বাড়ছে ‘অকল্পনীয়’ জোটের সম্ভাবনাও।
পথ কণ্টকাকীর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী গর্জনে বর্ষণের নিশ্চয়তার চেয়ে সন্দেহের উপাদান বেশি। এক দিকে ব্রিগেডের সভায় বিজেপি-বিরোধী দলগুলোকে আমন্ত্রণ, অন্য দিকে এ রাজ্যের সব ক’টি লোকসভা আসন দখল করার আস্ফালন— জোট রাজনীতির পরিপন্থী তো বটেই, সেই সঙ্গে এটি ভারত নামক ধারণাটার প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততার পরিচায়কও নয়। তাঁর বোঝা উচিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক পথে লড়াই চলে না। সে পথটা গণতান্ত্রিক, অধিকতর গণতান্ত্রিক।
অবশ্য, নির্বাচনী সাফল্য এবং রাজনীতির ময়দানে প্রকৃত বিরোধী গণ-আন্দোলনের অভাব তাঁকে এমন স্ব-গরিমার মোহে আচ্ছন্ন করেছে যে তিনি পরিস্থিতির বিচারে শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করতে অক্ষম। আমার বিশ্বাস, তাঁর চোখ খুলিয়ে দিতে বামপন্থীরা একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর দলের স্বৈরাচারী এবং জনবিরোধী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে, জনসাধারণের আশু সমস্যাগুলো সমাধানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলে। রেশনের চাল, কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী ইত্যাদিকে ব্যঙ্গ না করেও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করা যায়, এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ দাবি করা যায়, করা দরকার। গণতন্ত্রে জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামার কোনও বিকল্প নেই।
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ভাঙড় প্রভৃতি আন্দোলন দেখিয়ে দিচ্ছে যে ‘ভাঙব তবু মচকাব না’ জেদ ধরে থাকা শাসককেও গণ-আন্দোলনের সামনে ঝুঁকতে হতে পারে। কর্মহীনতা এ রাজ্যের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, হাজারে হাজারে সদ্য-কৈশোর-পার-করা বা না-করা ছেলে মাধ্যমিক পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই দেশান্তরী হচ্ছে আয়ের সন্ধানে। সমাজে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাদের ঠেলে দিচ্ছে বিভুঁয়ে। ‘এখানে থাকলে কাজ পাব না’, সুতরাং যত আগে কাজের বাজারে ঢুকে পড়া যায়, তা যতই ভিনরাজ্যে হোক না কেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা উঠে যাওয়ার জোগাড়, তার জায়গা নিচ্ছে সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল। মানুষের দেহের উপর কব্জা করছে ব্যবসায়িক চিকিৎসা পরিষেবা। মোদী-কেয়ারের নামে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে লুট করার যে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, এ রাজ্যের সরকারও তার বিরোধিতা তো করছেই না, বরং সেটাকেই মজবুত করার দিকে ঝুঁকছে। শিক্ষার অবস্থা কহতব্য নয়। শিক্ষার মতো একটা নৈতিকতার ভিত্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে জেগে উঠেছে দুর্নীতি ও আধিপত্য। বামপন্থীরা যদি এগুলো নিয়ে আন্দোলনে না নামেন, তা হলে লোকে তাঁদের ‘বামপন্থী’ বলে চিনবে কেন, গনবে কেন? ভাঙড়ে অলীক চক্রবর্তীদের ছোট সংগঠন যদি সেখানে বামপন্থী আন্দোলনকে সংহত করতে পারে, তা হলে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার বামপন্থী কর্মী সংগঠকরা কেন সেটা পারবেন না, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই।
প্রাসঙ্গিকতা আসে মতাদর্শ থেকে। মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন চিন্তা ও তা নিয়ে আন্দোলন থেকে। পরিস্থিতির ব্যাখ্যা আসে ‘বস্তুকে তার নিজস্ব অবস্থানে’ বিশ্লেষণ থেকে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা বামপন্থার গোড়ার কথা। সেটা তাঁরা কতখানি প্রয়োগ করতে পারবেন, তার ওপর শুধু তাঁদেরই ভবিষ্যৎ নয়, ভারতবর্ষের ধারণাটার সুরক্ষিত থাকাও নির্ভর করছে অনেকখানি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy