ব্রিটিশ রাজত্বকালেই জাতীয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ এবং ‘কৃষকের হাতে জমি’র স্লোগানকে জাতীয় আন্দোলনের অপরিহার্য অঙ্গ রূপে বিবেচনা করেছিলেন। বাংলা ছাড়াও বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হায়দরাবাদ, ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন ও গুজরাতে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, তাতে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলায় গঠিত হয়েছিল ‘ফ্লাউড কমিশন’, যা বর্গাচাষিদের নাম রেকর্ডভুক্ত করার এবং উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ চাষিকে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরাধীন ভারতে সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
তাই ব্রিটিশ শাসনের শেষ লগ্নেই শুরু হয়েছিল এক দুর্বার কৃষক আন্দোলন, যা ‘তেভাগা’ নামে পরিচিত। পুলিশ সেই আন্দোলনকে দমন করার জন্য গুলি চালিয়েছিল। শুধু দিনাজপুর জেলাতেই ৪০ জন কৃষকের মৃত্যু হয়। আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ ২২ বার গুলি চালায় এবং বহু কৃষকের মৃত্যু হয়। এই আন্দোলন স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও চালু ছিল। কাকদ্বীপের চন্দনপিড়ি মৌজায় গুলি চলেছিল এবং অনেক নারী-পুরুষ নিহত হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের সরকার ভূমি-সংস্কারে কোনও উদ্যোগ নেয়নি, তাই খাদ্য সংকটেরও কোনও সুরাহা হয়নি।
১৯৫৯ সালের ৩১ অগস্ট কয়েক লক্ষ মানুষ খাদ্যের দাবিতে কলকাতার রাজপথে মিছিল করলেন। তাঁদের উপর গুলি চলল এবং ৮০ জন নিহত হলেন। ১৯৬৬ সালে খাদ্য ও কেরোসিনের দাবিতে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে বাংলা উত্তাল হল। শহিদ হলেন আবুল, জব্বার, আশিস ও নুরুল ইসলাম সহ বহু তরতাজা যুবক। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন জমির প্রশ্নকে আবার সামনে নিয়ে এল। রাজ্য জুড়ে কৃষক আন্দোলন শুরু হল। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে কারারুদ্ধ হলেন। জমির জন্য সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রাম পরস্পর পরিপূরক হয়ে গেল।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন বর্গা, খাস জমি বণ্টন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষক সমস্যার আংশিক সমাধান হল। এ সবের ফলে পশ্চিমবঙ্গ চাল উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য থেকে উদ্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখনও মানুষের বহু সমস্যা থাকলেও কৃষকের জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্রামাঞ্চলে শিল্পজাত পণ্যের বড় বাজার তৈরি হয়েছে, স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার একটা প্রাথমিক কাঠামো গড়ে উঠেছে।
১৯৪৭ সালে যে লক্ষ্যগুলি অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল, সেই সব পূর্ণ করার জন্যই তেভাগা থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা পর্যন্ত নানাবিধ গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনগুলিতে যাঁরা শহিদ বা নির্যাতিত হয়েছিলেন, সমাজজীবনের অগ্রগতিতে তাঁরা অবদান রেখেছিলেন।
১৯৮৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গরিব নির্যাতিতাদের জন্য সামান্য কিছু ভাতার ব্যবস্থা করে। ২০১৩ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সেই ভাতা বন্ধ করে দেয়। ভাতা-প্রাপকরা ছিলেন খুবই গরিব, বয়স্ক ও অক্ষম। ভাতা বন্ধ হওয়ার পর কিছু মানুষ বিনা চিকিৎসায় ও অপুষ্টিতে মারা গেলেন। এই অবস্থায় রাজনৈতিক নির্যাতিতরা কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর মাননীয় বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাতা-প্রাপকদের আবেদন মঞ্জুর করে পুনরায় ভাতা চালু করার নির্দেশ দেন। রাজ্য সরকার কোর্টের নির্দেশ মানেনি। ভাতা-প্রাপকরা তখন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন। এখন রাজ্য সরকার বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেছে। সেই আপিলে রাজ্য সরকার দাবি করেছে যে, ১৯৮৮ সালের সরকারি আদেশ বলে ভাতা-প্রাপকরা কেউ রাজনৈতিক নির্যাতিত নন, ‘তাঁরা সবাই ক্রিমিনাল, কারণ পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্রাইম করার অভিযোগে তাঁরা কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।’
ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কংগ্রেস আমলে আমরা বহু বছর জেলে থেকেছি। কংগ্রেস সরকার আমাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির নানাবিধ ধারায় অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু তারা আমাদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’র স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে আমরা রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদার দাবিতে ২৭ দিন অনশন করেছিলাম। রাজ্য সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়ে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, যাবতীয় ইতিহাস এবং গণতান্ত্রিক বোধকে অস্বীকার করে বর্তমান রাজ্য সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু তো দিচ্ছেই না, উলটে তাঁদের ‘অপরাধী’ চিহ্নিত করছে। বিশ্বে রাজনৈতিক কারণে জেলে যাওয়ার নিদর্শন প্রচুর— এবং সেগুলি গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। যে কোনও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন লোকের চোখেই এই বন্দিত্ব সম্মানের। রাজ্য সরকার কি তা থেকে শিক্ষা নেবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy