Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অনধিকার

স্কুলটিকে কেন্দ্র করিয়া যে বিক্ষোভ চলিতেছে, তাহাতে অংশগ্রহণকারীদের দুইটি গোষ্ঠীতে ভাঙিয়া দেখা সম্ভব, এবং বিধেয়। যাঁহারা প্রত্যক্ষ ভাবে স্কুলটির সহিত যুক্ত, অর্থাৎ অভিভাবকরা, তাঁহারা প্রথম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪০
Share: Save:

এই সমাজকে অসচেতন বলিবে, সাধ্য কাহার! কলিকাতা শহরের একটি স্কুলের শিশু-ছাত্রীর উপর নিপীড়নের অভিযোগকে কেন্দ্র করিয়া শোরগোল অন্তহীন এবং সীমান্তহীন। বস্তুত, অন্য একটি স্কুলের সম্পর্কে অংশত অনুরূপ অভিযোগে সেখানেও অশান্তি অব্যাহত। স্কুলের সামনে অবস্থান হইতে শুরু করিয়া প্রতিবাদ মিছিল, মায় রাজপথ অবরোধ অবধি নিত্যকর্মের অঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। স্কুলের নিপীড়কদের ফাঁসির দাবিতে পিটিশনে সই পড়িতেছে, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা ধাইয়া আসিতেছে, মাঝেমধ্যে ‘হোক চিৎকার’ও ধ্বনিত। এবং রাজনীতির পরিচিত সওদাগররাও আসরে নামিয়াছেন। হাতে গরম বিচার ও শাস্তির হরেক দাওয়াই শোনা যাইতেছে। কেহ সামান্য ভিন্ন স্বরে কথা বলিতে চাহিলেই তাহাকে ‘ছুপা পিডোফাইল’ বলিয়া দাগিয়া দেওয়া যাইতেছে। এই উন্মাদনা বর্তমান ভারতেরই চরিত্রলক্ষণ। তাহার প্রথম প্রমাণ, এই ‘সচেতনতা’র কোনও রাজনীতি নাই। দলীয় পতাকা লইয়া আসর দখল করা নহে, এখানে যথার্থ রাজনীতির কথা বলা হইতেছে। সমাজের যে কোনও সমস্যাতেই যদি রাষ্ট্রের হাতে অধিকতর ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়ার দাবি উঠে, তাহা যথার্থ রাজনীতিবোধের ঘোরতর অভাবের পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত, এই ‘সচেতনতা’র কাণ্ডজ্ঞানও নাই। অভিযোগ প্রমাণিত হইবার আগে অবধি অভিযুক্তকে দোষী বলা চলে না, তাহার মানবাধিকার লঙ্ঘন হিংস্রতার নামান্তর হয়— সেই প্রাথমিক বোধটুকুও অন্তর্হিত। এই হিংস্রতাও কি বর্তমান ভারতেরই চিহ্ন নহে?

স্কুলটিকে কেন্দ্র করিয়া যে বিক্ষোভ চলিতেছে, তাহাতে অংশগ্রহণকারীদের দুইটি গোষ্ঠীতে ভাঙিয়া দেখা সম্ভব, এবং বিধেয়। যাঁহারা প্রত্যক্ষ ভাবে স্কুলটির সহিত যুক্ত, অর্থাৎ অভিভাবকরা, তাঁহারা প্রথম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় দলে আছেন অন্যান্যরা, যাঁহাদের এক কথায় ‘বহিরাগত’ বলিয়া চিহ্নিত করা যায়। যে ভঙ্গিতে বিক্ষোভ চলিতেছে, তাহার ন্যায্যতা লইয়াও প্রশ্ন করা চলে, কিন্তু আপাতত বৃহত্তর প্রশ্নটি এই দুই গোষ্ঠীর ভিন্নতা লইয়া। কোনও স্কুলে সমস্যা হইলে অভিভাবকরা তাহার অংশীদার। ক্ষোভ প্রকাশ করিবার, অথবা সমাধানসূত্র খুঁজিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা লওয়ার অধিকার তাঁহাদের আছে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর নাই। তাঁহারা অবশ্যই বিচলিত হইতে পারেন, নিজেদের উদ্বেগ, ক্ষোভের কথা প্রকাশ করিতে পারেন— কিন্তু, স্কুলের পরিসরে নহে। স্বাভাবিক সময়ে তাঁহারা যে পরিসরের অংশী নহেন, ‘অস্বাভাবিক’ মুহূর্তেও সেই পরিসরে তাঁহাদের অনুপ্রবেশ অন্যায়। যে কোনও পরিসরের ঘোলা জলেই মাছ ধরিতে চাওয়া যুগধর্ম হইতে পারে, নীতিসম্মত নহে।

কলিকাতার দুই ‘সচেতন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করিতে হয়। তাহাদের প্রতিবাদের ভঙ্গিটিও বিচিত্র। চিৎকার অথবা হাততালিতে যে সমস্যার সমাধান হয় না, তাহাদের ‘সচেতনতা’ সেই কথাটি স্বীকার করে নাই। কিন্তু, বৃহত্তর প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের বাহিরে তাহাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা কী? ছাত্র রাজনীতিকে যদি থাকিতেই হয়, তবে তাহা নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত থাকাই বিধেয়। কেহ পালটা প্রশ্ন তুলিতে পারেন— ছাত্র হিসাবে নহে, যদি সাধারণ নাগরিক হিসাবে ছাত্ররা জি ডি বিড়লার ঘটনার প্রতিবাদ করিতে চাহে, তবে আপত্তি কেন? উত্তর সহজ। প্রতিবাদের অধিকার এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অধিকার এক হইতে পারে না। প্রতিবাদের যুক্তিতে জনজীবন স্তব্ধ করিয়া দিবার স্বাধীনতা কাহারও নাই, ‘অধিকারসচেতন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও নাই। স্বাধিকারপ্রমত্ততা কোনও অবস্থাতেই মানিয়া লওয়া চলে না। বস্তুত, তাহা সংযত সুচিন্তার পরিপন্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Human rights Violation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE