Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

অধিকারের নামে অচলাবস্থা

পূর্ব মেদিনীপুরের তিনটি হাই মাদ্রাসার পরিচালন সমিতি ২০১৩ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করে।

মিলন দত্ত
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ওয়াশিংটনের ব্রুকলিন দোহা ইনস্টিটিউটের মূল্যায়ন ছিল, ‘সেকুলার শিক্ষার মডেল’। বাংলাদেশ সরকার চেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষার মডেল সে দেশে প্রয়োগ করতে। কর্নাটক সরকার তার রাজ্যে এই মডেলটাই নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে-সব এখন ইতিহাস। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল সরকার পোষিত মাদ্রাসাগুলো কার্যত ধুঁকছে। আদালতে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন নিয়ে আইনি টানাটানিতে ২০১৩ সালের পর থেকে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ বন্ধ। প্রায় ৬ লক্ষ ছাত্রছাত্রী নিয়ে ৬১২টি মাদ্রাসায় শিক্ষকের বিপুল ঘাটতির ফলে লেখাপড়া শিকেয়। এই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য সরকার কিছু করেনি। আশ্চর্য নীরবতা রাজ্যের মুসলিম সমাজেও।

পূর্ব মেদিনীপুরের তিনটি হাই মাদ্রাসার পরিচালন সমিতি ২০১৩ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করে। যুক্তি ছিল, সংবিধানের ৩০ ধারা মাদ্রাসায় শিক্ষক ও অশিক্ষক নিয়োগের পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ চলবে না। সংখ্যালঘু হিসাবে এটা তাঁদের মৌলিক অধিকার। ২০১৪ সালের মার্চে কলকাতা হাই কোর্ট মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে অবৈধ ঘোষণা করে। শিক্ষক নিয়োগে কমিশনকে সুপারিশ না করারও নির্দেশ দেয়। পরে ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয়, ২০০৮ সাল থেকে কমিশন যত শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ করেছে তাদের চাকরি নির্ভর করবে মাদ্রাসার পরিচালন সমিতির ওপর। ওই রায়ের বলে ২০০৮ সাল থেকে চাকরিরত ৯৭৩৮ জন শিক্ষকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শতাধিক শিক্ষকের নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। শিক্ষক পদে ৮৮ হাজার পরীক্ষার্থীর ফল প্রকাশ আটকে যায়। এই সিদ্ধান্ত রদের আবেদন নিয়ে সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায়নি। সরকারি ও বিরোধী দলের ছত্রছায়ায় থাকা শিক্ষক সংগঠনগুলোও এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি।

মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা ‘বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরাম’ নামে একটা সংগঠন গড়ে সার্ভিস কমিশনের অস্তিত্ব এবং শিক্ষকদের চাকরি রক্ষা করতে হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক অন্তর্বর্তী রায়ে জানায়, শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত রায় না বেরোনো পর্যন্ত কোনও মাদ্রাসা পরিচালন সমিতি শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করতে পারবে না। পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাতে ফোরামের সদস্যরা বিপুল আর্থিক দায় এবং চাকরির ঝুঁকি নিয়ে এই লড়াইয়ে নেমেছেন। মুসলমান সমাজের তাবড় সংগঠন বা সরকার, সকলে বিরোধিতায় তৎপর। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলাকালীন কিছু মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের চেষ্টা হয়। তা নিয়ে বিপুল আর্থিক লেনদেন এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে ফোরাম। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ করতেই সরকার ২০০৮ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন তৈরি করে রাজ্য সরকার।

মনে রাখতে হবে, এগুলো কিন্তু ধর্মশিক্ষার খারিজি মাদ্রাসা বা মক্তব নয়। হাই মাদ্রাসার পাঠক্রম একেবারেই মাধ্যমিকের মতো। কেবল ২০০ নম্বরের আরবি এবং ইসলামের ইতিহাস পড়তে হয়। একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির পঠন-পাঠন উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের অধীন। এই সব মাদ্রাসায় ছ’লক্ষেরও বেশি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে, বেশির ভাগই পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের বা হিন্দু অন্ত্যজ শ্রেণির। মাদ্রাসায় ২০ শতাংশের বেশি অমুসলিম। বাম আমলে সরকার হাই মাদ্রাসা এবং সিনিয়র মাদ্রাসাগুলোর খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ধীরে তাদের পাঠক্রম মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিকের সমতুল করা হয়। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন শিক্ষক নিয়োগে মানের দিকে নজর দেয়। মাদ্রাসা ব্যবস্থার এই সার্বিক উন্নতির সুফল পেয়েছে মুসলমানের সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ। মিশনভিত্তিক যে শিক্ষা আন্দোলন নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আল আমিন মিশন শুরু করে, তার সূতিকাগার ছিল হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের এক মাদ্রাসা। এ-রাজ্যের মুসলিম সমাজে আজ মিশনভিত্তিক শিক্ষার যে জোয়ার, সেখানেও হাই মাদ্রাসাগুলোর গভীর সম্পৃক্তি।

অথচ এখন ১৬ হাজার শিক্ষক পদের মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার পদে শিক্ষক নেই। রাজ্যে অনেক মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রী আছে কিন্তু শিক্ষক নেই। দেড়শো মাদ্রাসা চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। হুগলি এবং হাওড়া জেলায় দুটো মাদ্রাসা অনুমোদন পায় ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। সেখানে শিক্ষক নিয়োগই করা যায়নি। অনেক মাদ্রাসায় পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় শিক্ষিত তরুণরা। স্থানীয় মানুষ এবং অভিভাবকেরা চাঁদা তুলে তাঁদের হাতে নামমাত্র পারিশ্রমিক তুলে দেন। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১:৬০ ছাড়িয়েছে। গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া সমাজে মেয়েদের লেখাপড়ার সহজ সুযোগ ও ছেলেদের স্কুলছুট ঠেকাতে পারে এই সব মাদ্রাসা। মাদ্রাসা থেকে পাশ করে অনেকেই মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে পৌঁছয়। এমন একটা ব্যবস্থার অবনতিতে সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই।

মুসলমান সমাজের একটি অংশ তাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের নাম করে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। শাসকদল জানে মুসলমান সমাজের ক্ষতি করেও ওই মামলাবাজদের পাশে থাকাটাই রাজনীতির দিক থেকে সুবিধেজনক। রাজ্য সরকারের ‌এই ভূমিকা থেকে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন বোঝা যাবে, তেমনই পরিষ্কার হবে রাজ্যের মুসলিম নেতা-সংগঠনের অবস্থা ও অবস্থান। তাঁরা সক্রিয় বা সজাগ নয়, এমনটা ‌তো নয়। তসলিমা নাসরিনকে রাজ্য-ছাড়া করায়, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির প্রতিবাদে, বেকার হস্টেল থেকে মুজিবর রহমানের মূর্তি অপসারণের দাবিতে, তিন তালাক রদে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতিবাদে, এমনকী জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতিবাদে শহর অচল করা মিছিল-সমাবেশ-বিক্ষোভ হয়। কেবল মাদ্রাসার বেহাল দশা নিয়ে তাদের কোনও বক্তব্য নেই। কারণ সহজেই অনুমেয়। একে তো প্রায় সব ক’টি মাদ্রাসার পরিচালন সমিতি হয় শাসকদলের অনুগতদের নয়তো নেতা-কর্মীদের দখলে। দুই, সংখ্যালঘুর অধিকার সংক্রান্ত কোনও রায়ের বিরোধিতা করে মুসলিম ভোট হারাতে চাইবে কোন রাজনৈতিক দল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Deadlock situation Madrasah education system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE