Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অ-নৈতিক

তর্কাতীত মীমাংসার জন্য পরিসংখ্যান প্রয়োজন। বর্তমান জমানায় সরকারি পরিসংখ্যানকে কতখানি বিশ্বাস করা যায়, সেই প্রশ্নটি সরাইয়া রাখিলেও ভিন্নতর সমস্যা থাকে।

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নোট বাতিলের সাফল্য-ব্যর্থতা বিষয়ক তর্ক চলিতেছে। চলিবেও। তর্কের মীমাংসা হইবে, তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণতর। কারণ, তর্কাতীত মীমাংসার জন্য পরিসংখ্যান প্রয়োজন। বর্তমান জমানায় সরকারি পরিসংখ্যানকে কতখানি বিশ্বাস করা যায়, সেই প্রশ্নটি সরাইয়া রাখিলেও ভিন্নতর সমস্যা থাকে। প্রথম কথা, নোট বাতিল ছাড়াও অন্যান্য বহু ঘটনার অল্পবিস্তর প্রভাব গত এক বৎসরে অর্থনীতির উপর পড়িয়াছে। ফলে, গত ত্রৈমাসিকে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশে নামিয়া আসার পিছনে নোটবাতিলের ভূমিকা কতখানি, সেই বিষয়ে অনুমান চলিতে পারে— যুক্তিসংগত, তত্ত্বসিদ্ধ অনুমান— কিন্তু, তর্কহীন মীমাংসা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞতা বলিতেছে, নোট বাতিলের ধাক্কা সর্বাপেক্ষা বেশি লাগিয়াছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাহার আয়ের হিসাব হইয়া থাকে সংগঠিত ক্ষেত্রের একটি অনুপাত ধরিয়া। সেই হিসাব বোধগম্য কারণেই প্রকৃত ছবিটি দেখাইতে পারিবে না। অতএব, নোট বাতিল সংক্রান্ত তর্কটি একটি ভিন্নতর তলে হওয়া বিধেয়। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সম্প্রতি তেমনই একটি অভিমুখ খুলিয়াছেন। তাঁহার মতে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ভারতীয় অর্থনীতির যতখানি ক্ষতি করিয়াছে, তাহারও অধিক ক্ষতি করিয়াছে সেই ক্ষতি স্বীকার না করিবার মানসিকতা, ইহাকে ‘সফল’ নীতি প্রতিপাদনের উদগ্র প্রয়াস। তাঁহার মতে, ইহার ফলে শিল্পমহলের আস্থা নষ্ট হইয়াছে— অর্থনীতির তোয়াক্কামাত্র না করিয়া সরকার যে কোনও পথে হাঁটিতে পারে, এমন একটি আশঙ্কা ক্রমে গুরুতর হইয়া উঠিতেছে।

নোটবাতিলের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বারে বারেই ‘নৈতিকতা’র প্রসঙ্গ উঠিতেছে। অরুণ জেটলি বলিয়াছেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ সরকারের একটি নৈতিক সিদ্ধান্ত। কংগ্রেস পাল্টা প্রশ্ন করিয়াছে, যে সিদ্ধান্তে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে এতখানি অসুবিধায় পড়িতে হয়, তাহা কি নৈতিক হইতে পারে? নৈতিকতার মাপকাঠির তর্কটি বিস্তৃত এবং গভীর। কিন্তু, যাহা তর্কাতীত, তাহা হইল, নৈতিকতা কখনও অস্বচ্ছ হইতে পারে না। কোনও সিদ্ধান্ত কেন হইতেছে, তাহার বাস্তবায়নের পথ কী, এবং তাহার ফল কী হইল— যে নীতিতে এই প্রশ্নগুলির স্পষ্ট এবং সৎ উত্তর পাওয়া যায় না, তাহাকে ‘নৈতিক’ বলিয়া দাবি করিবার কোনও অবকাশই নাই। অরুণ জেটলিরা এই পরীক্ষায় ডাহা ফেল করিয়াছেন। অতএব, নৈতিকতার দামামা না পেটানোই মঙ্গল।

ভুল স্বীকার না করিবার বিপদ দ্বিমুখী। এক, ভবিষ্যতে একই বা ভিন্নতর কোনও ভুলের সম্ভাবনা থাকিয়া যায়। দুই, ভুল স্বীকার না করিলে তাহা সংশোধনেরও সুযোগ থাকে না, বরং ক্ষতির দিকগুলি ধামাচাপা দিয়া রাখাই মুখ্য হইয়া দাঁড়ায়। কথাটি যে শুধু অর্থনীতির জন্য সত্য, শুধু নরেন্দ্র মোদীর সরকারের জন্য সত্য, তাহা নহে। ঘরের কাছেই উদাহরণ আছে। রাজ্য সরকার ডেঙ্গির প্রকোপ বুঝিতে ও তাহার মোকাবিলা করিতে ব্যর্থ, এই কথাটি স্বীকার করিবার মতো সৎসাহসের অভাব এক বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি করিয়াছে। কৌশিক বসুর কথাটি এই ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। ভুল হইয়াছে, তাহা এক প্রকার বিপদ। ভুল স্বীকার না করিয়া বিপরীতবুদ্ধি অনুসরণ করিলে বিপদ বহুগুণ বাড়িয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গ তাহা টের পাইতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Debate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE