Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হিন্দুত্বের কোপ

মুখ্য প্রশ্ন হইল, বর্তমান ভারতে দলিত বিদ্যাচর্চার অন্যতম মুখ কাঞ্চা ইলাইয়ার বইয়ে বিজেপি-পোষিত শিক্ষক সংগঠনের আপত্তি কেন?

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২৩
Share: Save:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ড-এর বই রাখিতে অসম্মত হইয়াছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যাকাডেমিক অ্যাফেয়ার্স। কোন পাঠ্যক্রমে কোন বই থাকিবে, সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার এই কমিটির আছে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। গৌণও। মুখ্য প্রশ্ন হইল, বর্তমান ভারতে দলিত বিদ্যাচর্চার অন্যতম মুখ কাঞ্চা ইলাইয়ার বইয়ে বিজেপি-পোষিত শিক্ষক সংগঠনের আপত্তি কেন? এমন সহজ প্রশ্ন আর হয় না। নাগপুর যাহাকে ‘বৃহৎ হিন্দুত্ব’ বলিয়া চালাইতে চাহে, কাঞ্চা ইলাইয়ার অস্তিত্ব ও মতামতের সবটাই সেই ধারণার বিরোধী। মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও নিম্নবর্ণের সহাবস্থান যে হিন্দুত্বের ইতিহাস নহে, বরং প্রথম জনগোষ্ঠীর হাতে দ্বিতীয় জনগোষ্ঠীর (যাহা সংখ্যায় অনেক বড়, কিন্তু সামাজিক ক্ষমতায় হীনবল) তুমুল হেনস্থাই ঐতিহাসিক বাস্তব, এই কথাটি যত বেশি উচ্চারিত হয়, নাগপুরের ততই অসুবিধা। তাহা হইলে অখণ্ড হিন্দুত্বের কাল্পনিক ধারণাটিকে রাজনীতির পরিসরে বেচা মুশকিল, জিগ্নেশ মেবাণীদের প্রশ্ন ঠেকাইবার কোনও উপায় থাকে না। কাঞ্চা ইলাইয়া ঠিক এইখানেই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁহার গবেষণা ও লেখনী নিরন্তর জানাইয়াছে, নিম্নবর্ণের সমাজ ঐতিহাসিক ভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ হইতে পৃথক। তাঁহাদের রীতিনীতি পৃথক, সংস্কৃতি, খাদ্য, জীবনযাত্রা ও দর্শনের প্রশ্নে তাঁহাদের সমাজ অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। অর্থাৎ, যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে নাগপুর তাহাদের হিন্দুত্বের খাপে ভরিতে সচেষ্ট, কাঞ্চা ইলাইয়ার গবেষণা তাঁহাদের পৃথক অস্তিত্বের পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়াছে।

অতএব, বিজেপি-পোষিত সংগঠন তাঁহার বইগুলিকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলিবে, তাহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। বস্তুত দ্বন্দ্বটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে সীমাবদ্ধ নহে। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হইল, দলিত, পিছড়ে বর্গের জনগোষ্ঠীকে হিন্দুত্বের সংজ্ঞায় ধরা যায় কি না। হিন্দুত্বকে কি সাভারকর-গোলওয়ালকরের মতের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা বিধেয়, না কি অম্বেডকর বা কাঞ্চা ইলাইয়াদের দৃষ্টিভঙ্গিতে? নাগপুরের উত্তরটি জানা। গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অব থটস্ বলিতেছে: ‘‘বর্ণভেদপ্রথা সহস্রাধিক বৎসর আমাদের জাতীয় জীবনের অঙ্গ। সেই প্রথা জাতির উন্নতিতে কোনও বাধা সৃষ্টি করিয়াছে, অথবা জাতীয় একতায় ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে, এমন প্রমাণ নাই। বরং, তাহা সামাজিক ঐক্য বজায় রাখিতে বিপুল সহায়তা করিয়াছে।’’ উচ্চবর্ণের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিলে ইহার ন্যায় খাঁটি কথা আর হয় না। তিনি লিখিয়াছেন, বর্ণভেদপ্রথা তৈরি হইয়াছিল সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের কাজ নির্দিষ্ট করিয়া দিতে। সেই ব্যবস্থায় তিনি অন্যায় দেখেন নাই, বিলোপের দাবিটিকেই বরং অপ্রয়োজনীয় বলিয়াছেন। সামাজিক উচ্চাবচতার সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়াইয়া সেই সুবিধা অটুট রাখিবার তাগিদে তাঁহারা এমন বলিতেই পারেন, কিন্তু, উচ্চবর্ণের আধিপত্য ভাঙাই তো দলিত রাজনীতির লক্ষ্য। ফলে, গোলওয়ালকরের উত্তরসূরিরা যে কাঞ্চা ইলাইয়ার বিরোধিতা করিবেন, তাহাও প্রত্যাশিত। দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে প্রকৃত বিদ্যাজীবীর সংখ্যা দৃশ্যত কম হওয়ায় তাঁহারা কাঞ্চা ইলাইয়ার বিরুদ্ধে সারস্বত যুক্তি সাজাইয়া উঠিতে পারেন নাই। সত্য কথাটি বলিয়া দিলেই বরং সুবিধা হইত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE