নোট বাতিল নিয়ে অর্থনৈতিক তরজার একটি বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কালো টাকার ওপর এর প্রভাব। কিছু দিন আগে সেই বিতর্কে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গর্ভনর রঘুরাম রাজনের একটি মন্তব্য। অনেকের মতো তিনিও বলেছেন যে, কালো টাকা ব্যাংকে সাদা হয়ে জমা পড়ার পর তার ওপর ব্যাংকগুলোকে সুদ দিতে হচ্ছে এবং সেই দায়ভার তো সরকারের ওপরেই বর্তায়। টাকা কালো থাকলে সেই সুদ দিতে হত না। তাই নোট বাতিলের নীতি এক অর্থে কালো টাকাকে শুধু সাদা করারই একটা সুযোগ করে দেয়নি, সেই টাকার ওপর সুদ দিয়ে সরকার তাঁদেরই আরও সুবিধে করে দিচ্ছেন। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এ জাতীয় মন্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করেও খানিকটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
অনেক সময় অর্থনীতিকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাতে বিষয়টিকে অসম্মান করা হয়। সমালোচনার গতিপ্রকৃতি যেন ঠিক হয়, এই দিকটিতে বিশ্লেষকের বিশেষ ভাবে নজর দেওয়ার প্রয়োজন। মানুষ যা শুনতে চায় বা মানুষকে যা শোনাতে চাই— সেটা সব সময় যুক্তিগ্রাহ্য না-ও হতে পারে। কালো টাকা ও নোট বাতিলের ক্ষেত্রেও কথাটা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা পর পর কয়েকটি যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করব।
কালো টাকা কর ফাঁকি দিয়ে কিংবা অন্যায় বা বেআইনি ভাবে রোজগার করে জমা করা হয়। কিন্তু বাড়িতে সব কালো টাকা থাকে না। দেশের সুবৃহৎ ইনফর্মাল বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কালো টাকা বিনিয়োগ করা হয়, আর কিয়দংশ বাড়িতে জমা থাকে। কালো টাকা বিনিয়োগের ফলে সম্পদও সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচে। সে সব ব্যবসায় সোজা পথে ঋণ পাওয়া যায় না। তাই কালো টাকা সাদা করার পর দেশের অসংগঠিত অর্থনীতি মুষড়ে পড়তে পারে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এটা জানেন, কিন্তু অনেক সময় বলেন না।
বাড়িতে জমে থাকা কলো টাকা বাজারে ব্যবহৃত হলেও তা কোনও ভাবে দশের উপকারে সরাসরি লাগে না। বাজারে যে কালো টাকা খাটছে সেটা সরকারের হাতে গেলে বা ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে যাঁরা আকছার ব্যাংকের ঋণ ফেরত দেন না তাঁদের হাতে গিয়ে জমলে, দেশের মঙ্গলের পরিমাণ বাড়বে কি না সেটাও বিশ্লেষণ এবং বিচারের বিষয়। কিন্তু তা নিয়ে বিতর্কের সৎসাহস অনেকেরই নেই।
ধরা যাক, একশোটি কালো টাকা সাদা হয়ে ব্যাংকে ঢুকল। তার পর কী হবে? এটা সত্যি, ওই একশো টাকার ওপর ব্যাংককে সুদ দিতে হবে। কিন্তু ওই একশো টাকা ব্যাংক অন্যকে ধার দিতে পারে। ধার দেওয়া বাবদ ব্যাংক যে সুদ পায়, সেটা ব্যাংক আমানতের ওপর যত সুদ দেয় তার চেয়ে বেশি। তফাতটা এখন দুই শতাংশ মতো। সুতরাং ওই একশো টাকার জন্য ব্যাংক ২ টাকা নেট লাভ করবে। ওই একশো টাকা বাড়ির মাটির নীচে পড়ে থাকলে ওই ২ টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বা পরোক্ষে সরকার পেত না। তাই, বড় অর্থনীতিবিদরা শুধু ক্ষয়ক্ষতির দিকটা নিয়ে কথা বললে আবার ভয় পেয়ে অর্থনীতির বইপত্র ঘাঁটতে হয়।
তবে এর কোনও গ্যারান্টি নেই যে, ওই একশো টাকা ধার দেওয়ার মতো লোক ব্যাংক পেয়ে যাবে। ফলে ঋণগ্রহীতার অভাবে ওই একশো টাকার ওপরে (এখনকার হারে) ৬ টাকা ৭৫ পয়সা ব্যাংককে দিয়ে যেতে হবে। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতেই বোধহয় প্রাক্তন গভর্নর ওই মন্তব্যটি করেছিলেন।
আবার ধরা যাক, ওই একশো টাকা এমন এক জনকে ধার দেওয়া হল, যাঁর অন্যান্য কোম্পানি ব্যাংকে অনেক ঋণ শোধ করেনি। মনে রাখতে হবে, এক জন ব্যবসায়ী অনেক কোম্পানির আসল মালিক হতে পারেন এবং তাঁর অনেক কোম্পানি অনাদায়ী ঋণকাণ্ডে অভিযুক্ত হলেও তিনি অন্য ব্যবসাতে ঋণ পেতেই থাকেন। আবার অনেক ধরা পড়লেও শাস্তি পান না। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, ব্যাংকে জমা পড়া ওই (কালো থেকে সাদা) একশো টাকার গন্তব্যস্থল আসলে কোথায়, কে জানে।
আবার এ রকমটাও দেখা গিয়েছে, যখন বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাংক কাউকে ঋণ দিতে অস্বীকার করছে, তখন তিনি, হয়তো সরকারের হাত ধরছেন বলে, এ দেশের কোনও বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিদেশের মাটিতে ব্যবসা করার জন্য তাঁকে দিব্যি ঋণের জোগান দিয়েছে। সেই নীতি ভাল না খারাপ সেটা ভবিষ্যৎই বিচার করবে। কিন্তু ওই সাদা হওয়া একশো টাকা আসলে উপকার করবে না অপকার করবে, কার উপকার করবে বা জনগণ ঠিক কী ভাবে তার থেকে উপকার পাবেন, সেটা বিচার করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।
(চলবে)
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy