Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
ডিপ্রেশন যে নিছক মন খারাপ নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানে না

দরকার চিকিৎসকের সাহায্য

স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই ধরনের নানান পোস্টার প্রায়ই দেখা যায় মন্ত্রকের টুইটার অ্যাকাউন্টে। ভ্রান্ত ধারণা এবং অপেশাদারি জ্ঞানে ঠাসা কয়েকটি পোস্টার এর মধ্যেই জন্ম দিয়েছে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় ও অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১৬
Share: Save:

কেবল মুঠোয় বন্দি কফির একলা কাপ

ডিপ্রেশনের বাংলা জানি। মনখারাপ। (শ্রীজাত)

কবি যা-ই লিখুন না কেন, ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ যে নিছক মন খারাপের চেয়ে খানিক বেশি কিছু, তা নিয়ে দেশে বেশ কিছু কাল ধরেই সচেতনতা বৃদ্ধির একটা চেষ্টা চলছে। ২০১৭-র মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা আইনের পিছনেও এই আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভারতে যে মানসিক রোগ অচিরেই মহামারির আকার ধারণ করতে পারে, সেই মর্মে মাস কয়েক আগে সতর্কবার্তা দেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। তিনি বলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে সমস্ত মানুষের কাছে মানসিক রোগের চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটিকে নিতে হবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে।

রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য এবং জন-আন্দোলনের এই ধারাটির সম্পর্কে সমস্ত রকম সরকারি স্বীকৃতির মূলেই যেন জল ঢেলে দিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক একটি পোস্টার।স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই ধরনের নানান পোস্টার প্রায়ই দেখা যায় মন্ত্রকের টুইটার অ্যাকাউন্টে। ভ্রান্ত ধারণা এবং অপেশাদারি জ্ঞানে ঠাসা কয়েকটি পোস্টার এর মধ্যেই জন্ম দিয়েছে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের। ব্যতিক্রম নয় সাম্প্রতিক পোস্টারটিও। মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্য বাতলানো হয়েছে দশটি দাওয়াই। সেগুলি হল— রুটিন মেনে চলা, বেড়াতে যাওয়া, সৃষ্টিশীল হওয়া, ভিটামিনের বড়ি খাওয়া, সদর্থক চিন্তা করা, যোগব্যায়াম করা, পরিচ্ছন্ন থাকা, আট ঘণ্টা ঘুমোনো, ফল খাওয়া এবং হাঁটা। নিন্দুকেরা বলছেন, অবসাদে ভোগা রোগীকে সুস্থ করার জন্য তাঁকে সদর্থক চিন্তা করতে বলা বা পর্যাপ্ত ঘুমোতে বলা আর গরিব মানুষকে দারিদ্র এড়াতে বড়লোক হয়ে যেতে বলার মধ্যে বিশেষ তফাত নেই।

পোস্টারটির উপরে হ্যাশট্যাগ দিয়ে অবসাদের সংজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রকের মতে ‘‘অবসাদের অর্থ মনমরা ভাব, যার প্রভাব পড়ে এক জন মানুষের ভাবনাচিন্তা, আচরণ এবং ভাল থাকার বোধের উপরে। অবসাদগ্রস্ত মানুষটির উচিত এমন কিছু কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, যা তাঁকে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করবে।’’ অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা স্পষ্টই বলছে, অবসাদ হল একটি সাধারণ মানসিক অস্বাভাবিকতা। এর লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা, পছন্দের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং অন্তত দু’সপ্তাহ ধরে প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে অসমর্থ বোধ করা। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মনঃসংযোগ কমে যাওয়া, খিদে নষ্ট হওয়া, বেশি বা কম ঘুমোনো, নিজেকে অপরাধী বা অপদার্থ ভাবা, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, ঠিকমতো চিকিৎসা হলে রোগটি সেরে যায়। মানসিক অসুস্থতাকে যথাসম্ভব লঘু করে দেখিয়ে মন্ত্রকের বার্তা বা পোস্টার, কোনওটিই উল্লেখ করেনি চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার কথা।

২০১৫-১৬ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উদ্যোগেই সম্পাদিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে চিকিৎসা পরিষেবার ভয়াবহ অপ্রতুলতার বিষয়টি তুলে ধরা। বেঙ্গালুরুর নিমহ্যান্স (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্‌থ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস) সমীক্ষাটি করেছিল বারোটি রাজ্যে ৩৪৮৯৭ জন মানুষের উপরে। সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে মানসিক রোগে ভুগছেন শতকরা এগারো জন। তাঁদের অধিকাংশই কোনও রকম চিকিৎসা পান না। অসুখের ধরন অনুযায়ী কোনও রকম চিকিৎসা না পাওয়া মানুষের অনুপাত ঘোরাফেরা করে ৭০ থেকে ৯২ শতাংশের মধ্যে। আরও আশঙ্কার কথা, ২০০৩ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সমীক্ষার মতো এই সমীক্ষাটিও দেখিয়েছে যে, এ দেশে মানসিক রোগে সব চেয়ে বেশি ভোগেন সমাজের দরিদ্র অংশ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দারিদ্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে মানসিক অবসাদের। অন্য দিকে, মানসিক অসুস্থতার জন্য কমতে থাকে কর্মক্ষমতা এবং রোজগার। দারিদ্র এবং মানসিক অসুস্থতা, দুইয়ে মিলে তৈরি হয় একটি দুষ্টচক্র। মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে লোকলজ্জার পাশাপাশি বাধা হিসেবে উঠে এসেছে পরিষেবার অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসার খরচ। সব অংশের মানুষের কাছে মানসিক রোগের চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচির ছিদ্রগুলি তুলে ধরেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট।

২০০৩ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছিল দরিদ্রদের মধ্যে মন খারাপ, দুর্ভাবনা, অস্থিরতা এবং ঘুমের সমস্যা সব চেয়ে বেশি, এবং মানসিক রোগের চিকিৎসা করানোর হার তাঁদের মধ্যে সব চেয়ে কম। ‘হাউসকিপিং’-এর কাজে ঢুকেছিল বিকাশ। কিছু দিনের মধ্যেই সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিল ওর তন্নিষ্ঠ ভঙ্গিতে কাজ করে যাওয়ার জন্যে। বেশি কথা বলে না। কিন্তু কাজে কোনও ফাঁকি নেই। এক দিন খুব উদ্বিগ্ন মুখে অধিকর্তাকে বলল, ‘স্যর, আমায় ছাড়িয়ে দেবেন না তো?’ বোঝানো হল, সে রকম আশঙ্কার কোনও কারণই নেই। ক’দিন পরে, পর পর দু’দিন এল না। বাসায় গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে কাঁদতে কাঁদতে বিকাশ জানায়, ও আর কাজ করতে পারবে না। ওর মা’র কাছ থেকে জানা গেল, এর আগেও এমন হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারবাবু দেখে ওষুধও দিয়েছিলেন। কিন্তু ওষুধ নিয়মিত খাওয়া হয়নি। পর দিন দুপুরে বিকাশের মা ঘরে ফিরে দেখেন বিকাশ আত্মহত্যা করেছে। সময়মতো চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারলে হয়তো বিকাশকে এ ভাবে চলে যেতে হত না।

কলকাতার অনতিদূরে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কয়েকটি গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি, হতাশা, অজানা আশঙ্কা, ঘুমের সমস্যা বা মন খারাপের কথা বলছেন অনেকেই। তাঁদের অধিকাংশই হতদরিদ্র পরিবারের, প্রতিনিয়ত যাঁদের জুঝতে হয় কর্মসংস্থানের অভাব, শারীরিক অসুস্থতা, অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতার মতো নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে। সেই জন্যই বোধ হয় মানসিক সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখানোর প্রশ্নটি ওঠে না অসুস্থতা চরম পর্যায়ে যাওয়ার আগে।

নিমহ্যান্সের রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি, সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ মানসিক অসুস্থতার কথা অস্বীকার করেন লোকলজ্জার কারণে। তাঁরা বরং সহজেই মেনে নিতে পারেন যে পরিবারের এক জনকে ভূতে ধরেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে প্রথমে ওঝা বা তান্ত্রিকের দ্বারস্থ হওয়াটাই দস্তুর। ফল খাওয়া বা বেড়াতে যাওয়ার মতো পরামর্শগুলি দেওয়ার সময়ে মানসিক অসুস্থতার সম্ভাব্য রোগী হিসেবে সমাজের কোন অংশের কথা মাথায় রাখা হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখাচ্ছে, সপ্তাহে এক বারও কোনও ফল খান না দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ। দরিদ্রদের মধ্যে হিসেবটা সেখানে ৮০ শতাংশেরও বেশি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট যথার্থই বলছে, বাড়াতে হবে সরকারি পরিষেবার জোগান এবং সচেতনতা। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা আইনেও যেখানে স্বীকৃতি পেয়েছে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, সেখানে মন্ত্রকের তরফে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন পোস্টার যেন অকারণেই হঠাৎ কয়েক পা পিছিয়ে আসা। আরও কয়েক মাস আগে মেদবাহুল্য নিয়ে আর একটি পোস্টার দিয়েছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক। তাতে ছিল পাশাপাশি দুই মহিলার গ্রাফিক ছবি। বার্বি ডলের মতো অতি ক্ষীণকায় এক জনকে দেখানো হয়েছিল সুস্বাস্থ্যের প্রতিভূ হিসাবে। তাঁর শরীর জুড়ে স্বাস্থ্যকর, সুষম এবং অবশ্যই নিরামিষ খাদ্যসামগ্রীর ছবি। অন্য জনকে দেখানো হয়েছিল স্থূলকায় হিসেবে। তাঁর দেহ জুড়ে নানান অস্বাস্থ্যকর খাবারের ছবি। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের পাশাপাশি সেই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিল ডিম! তা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। পাশাপাশি মহিলাদের শরীর সম্পর্কে অসংবেদনশীল হওয়ারও অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করে তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলা হয় পোস্টারটি।

এ বারও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাতে পোস্টারটি সরানো হল কি না, সেটা বড় প্রশ্ন নয়। সরকারের মন সচেতন হল কি? ইতিবাচক উত্তর দেওয়ার মতো আশাবাদী হওয়া মুশকিল।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-য় যথাক্রমে অর্থনীতির শিক্ষক ও অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Depression Health Suicide Assistance Medical
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE