Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঘনরামের ‘ধর্মমঙ্গল’-এ সমাজ জীবনের ছবি

অস্থির সময়ে মনসা, চণ্ডী প্রমুখ দেবীর পাশে মঙ্গলকাব্যের আঙিনায় প্রবেশ করলেন ধর্মঠাকুর। রূপরামের মতো কবি সপ্তদশ শতকেই এগিয়ে এসেছিলেন ধর্মঠাকুরের আখ্যান রচনায়। তা পূর্ণতা পেল ঘনরামের কাব্যে। লিখছেন স্বপ্নকমল সরকারসাড়ে তিনশো বছর আগে বর্ধমানের ‘কৈয়ড় পরগনার কৃষ্ণপুর গ্রামে’ (‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড’, সুকুমার সেন) যখন কবিরত্ন ঘনরাম চক্রবর্তী জন্ম নেন, তখন বাংলায় এক স্থবির যুগ চলছে।

ঘনরাম চক্রবর্তী স্মরণে মেলা। ছবি: উদিত সিংহ

ঘনরাম চক্রবর্তী স্মরণে মেলা। ছবি: উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১৯
Share: Save:

বাঙালির ইতিহাস না থাকা নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সাহিত্য সমালোচকেরা বলে থাকেন, অন্তত ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাসের ছায়াপাত ঘটেছিল সেই সময়ের সাহিত্যে। মধ্যযুগের নানা অভিঘাত স্পর্শ করেছিল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে শুরু করে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যকে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের মতো সাহিত্য তাত্ত্বিকেরা অষ্টাদশ শতককে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগ-সন্ধিক্ষণ বলে অভিহিত করে থাকেন। অষ্টাদশ শতকে রামপ্রসাদের গানে ফুটে ওঠা সমাজচিত্র বা ভারতচন্দ্রের কাব্যে সে কালের জীবনযাপনের যে ছবি মেলে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। কিন্তু, সে সময়ে আরও এক জন কবি ছিলেন, যাঁর কাব্যে সে সময়ের রাঢ় বাংলার সমাজজীবন মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি সপ্তদশ শতকের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। সে সময়ের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, অভাব, অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের একজোট হওয়ার যে ছবি তিনি ধর্মমঙ্গল কাব্যে এঁকেছেন, তাতে কাব্যটি সেই সময়ের এক অমূল্য দলিল হয়ে উঠেছে।

সাড়ে তিনশো বছর আগে বর্ধমানের ‘কৈয়ড় পরগনার কৃষ্ণপুর গ্রামে’ (‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড’, সুকুমার সেন) যখন কবিরত্ন ঘনরাম চক্রবর্তী জন্ম নেন, তখন বাংলায় এক স্থবির যুগ চলছে। হিন্দু উচ্চবর্ণের ধারাবাহিক নিপীড়ন, শাক্ত ও বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব, ধর্মান্তরণের পাশাপাশি, চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর কিছু দিন বাদেই বাংলায় ঘটবে বর্গী আক্রমণের মতো ঘটনা। সেই অস্থির সময় মনসা, চণ্ডী প্রমুখ দেবীর পাশে মঙ্গলকাব্যের আঙিনায় প্রবেশ করলেন ধর্মঠাকুর। রাঢ় বাংলার রূপরামের মতো কবি সপ্তদশ শতকেই এগিয়ে এসেছিলেন ধর্মঠাকুরের আখ্যান রচনার কাজে। তা পূর্ণতা পেল ঘনরামের কাব্যে।

কীর্তিচন্দ্র রায় (মহারাজ কীর্তিচাঁদ রাই) তখনও কাগজেকলমে বর্ধমানের রাজা হননি। বর্ধমানের সলিমাবাদ পরগনার তিনি জমিদার। পরে পিতামহ কৃষ্ণরাম রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে, বিষ্ণুপুরের রাজাকে পরাজিত করলেন তিনি। বর্ধমানে সুস্থিতি এনে প্রজাদের কাছে ‘রাজা’ হয়ে উঠলেন তিনি। এহেন কীর্তিচাঁদের সভাকবি ঘনরাম তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্যে প্রথম ‘রাজা’ সম্বোধন করে লিখলেন, ‘জগৎ রায় পুণ্যবন্ত পুণ্যের প্রভায়/ মহারাজচক্রবর্তী কীর্তিচন্দ্র রায়।।/ আশীর্ব্বাদ করিয়া তায় বসিয়া বারামে।/ কইয়ড় পরগনা বাটী কৃষ্ণপুর গ্রামে।।" (সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড)।

ঘনরাম যখন ধর্মমঙ্গল লিখেছিলেন, তখন বাংলায় এক অস্থির সময় চলছে। জমিদার ও স্থানীয় শাসকদের সাধারণ প্রজাদের উপরে অত্যাচারের মাঝেমধ্যে বর্ণনা ধর্মমঙ্গলের পাতায় পাতায় লেখা হয়েছে। এক সামান্য গোপালক প্রজা ইছাই ঘোষের অন্ত্যজ হাড়ি-বাগদি-ডোমেদের সংঘবদ্ধ করা এবং গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ও বিজয়ী হওয়ার কথার পাশাপাশি, ঘনরামের কাব্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে সমকালীন যুগে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাসও। ঘনরামের কাব্যে থাকা ‘রাজার মঙ্গল চিন্তি দেশের কল্যাণ’ পঙ্‌ক্তিটিকে উদ্ধৃত করে সুকুমার সেন মহাশয় বলেছিলেন, ‘‘ঘনরামের ধর্ম্মমঙ্গলে পাইলাম দেশাত্মবোধের প্রথম উন্মেষ’’।

ঘনরামের কাব্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সে সময়ের সমাজে হিন্দু, মুসলিম সম্প্রীতিকে লিপিবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে। ধর্মমঙ্গলে হিন্দু, মুসলমানের একত্রে রুটি ভাগ করে খাওয়ারও বর্ণনা রয়েছে। গরিব মুসলমানের কাছেও ধর্মদেবতা সে যুগে ক্রমশ আরাধ্য হয়ে উঠেছিল বলে ঘনরাম দেখান।

তবে রাঢ় বাংলায় ঘনরাম আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন ঘনরাম মেলার হাত ধরে। কবির জন্মস্থান বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমানের কৃষ্ণপুর গ্রামে একুশ শতকের সূচনালগ্নে ঘনরাম চক্রবর্তীর বংশধরদের হাত ধরে গড়ে ওঠে ‘কবি ঘনরাম স্মৃতিরক্ষা কমিটি’। ঘনরামের হাত ধরে তাঁর জন্মস্থানে যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল তা আজও রয়েছে। ঘনরামের পুথি এখানে দীর্ঘকাল সংরক্ষিত ছিল। পরে তা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেপে প্রকাশিতও হয়েছে। তাঁর জন্মভিটেতে গড়ে উঠেছে ঘনরামের সৌধ। ঘনরামের স্মৃতি কমিটির উদ্যোগে প্রতি বছর ঘনরাম মেলারও আয়োজন করা হচ্ছে।

চলতি বছরের ঘনরাম মেলা আঠারো বছরে পা দিল। ফি-বছর কমিটির উদ্যোগে এই গ্রামে চারদিনের মেলায় আয়োজিত হয় আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এই মেলায় এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তিপদ রাজগুরু, নারায়ণ দেবনাথ প্রমুখ। চলতি বছরেও ঘনরাম মেলা উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঘনরামের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই মেলার পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে তাঁর ধর্মমঙ্গলের আর এক চরিত্র ইছাই ঘোষের অনুষঙ্গবাহী বনকাটি গ্রামের ইছাই ঘোষের দেউলেও।

লেখক বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dharmamangal Ghanaram Chakrabarty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE