Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দিকে দিকে সংঘর্ষের ছবি

শ্রীনগরে স্কুল ছাত্ররা এখনও সুযোগ পেলেই পাথর ছুঁড়ছে। অতএব ওদের দমন করতেই হবে। ওদের হাতে বন্দুক নেই তাই। না হলে অনায়াসে গুলি করে ওদের ঢিট্ করে দেওয়া যেত।

ভিন্নমতাদর্শী: কাশ্মীরে নাগরিক উষ্মার বিস্ফোরণ, সেনাবাহিনীর দিকে তাক করে পাথর ছুঁড়ছে অল্পবয়সীদের দল। শ্রীনগর, ২৭ মে। রয়টার্স

ভিন্নমতাদর্শী: কাশ্মীরে নাগরিক উষ্মার বিস্ফোরণ, সেনাবাহিনীর দিকে তাক করে পাথর ছুঁড়ছে অল্পবয়সীদের দল। শ্রীনগর, ২৭ মে। রয়টার্স

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ম ধ্যপ্রদেশে কৃষকদের উপর গুলি। এই কৃষকরা ভারি বেয়াদপ, যতই আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী, তারা মানছে না। পুলিশ গুলি চালাবে না তো কি রসগোল্লা ছুঁড়বে?

শ্রীনগরে স্কুল ছাত্ররা এখনও সুযোগ পেলেই পাথর ছুঁড়ছে। অতএব ওদের দমন করতেই হবে। ওদের হাতে বন্দুক নেই তাই। না হলে অনায়াসে গুলি করে ওদের ঢিট্ করে দেওয়া যেত।

মেঘালয়ের বিজেপি নেতা বলে কি সাত খুন মাফ? অখণ্ড ভারতের অখণ্ড নীতি। খ্রীষ্টধর্মে কী বলা হয়েছে শুনতে চাই না। উত্তরপূর্বাঞ্চলে অতীতে কী হয়েছে জানতে চাই না। এই হিন্দুত্বের ভারতে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।

সংবাদচ্যানেল বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? বাড়িতে সিবিআই হানায় এত গোঁসা ? আইনসংগত কিনা তাও বিচার করবে রাষ্ট্র! নাগরিক সমাজের ‘প্রাইভেসি’র মৃত্যু, বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী স্বার্থে।

এ রকম দৃশ্য প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে আজ। আর এহেন দৃশ্যসমষ্টির কোলাজ দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি। বিষণ্ণ হচ্ছি। এটাই কি আমার ভারত? স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা চেয়েছিলাম ‘স্ব-রাজ’। আত্মশাসন। আর আজকের এই ঘটনার মিছিল কি সেই আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্যর নমুনা?

সিডনি ও বিয়েত্রিস ওয়েব, ১৯১১-১২ সালে চারমাস ভারতের নানা প্রান্ত ঘুরে ‘ইন্ডিয়ান ডায়েরি’ নামে একটি অপূর্ব বই লেখেন। এরা দুজনেই লন্ডনের প্রখ্যাত ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। পঁচাত্তর বছর এই ডায়েরিটি পায়নি কেউ। ১৯৮৭ সালে এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ওঁরা দুজন কলকাতায় কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশনে যোগ দেন। গোখলে, অ্যানি বেসান্ত, সি এফ অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে কথা বলেন। নানা মহারাজ, নবাব-বেগম, আইসিএস অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেন। বারাণসী থেকে পুনে, কলকাতা থেকে লাহৌর, চরকির মত ঘোরেন। ইলাহাবাদের কুম্ভমেলা দেখেন, কলকাতায় এসে জগদীশ বসু ও তার স্ত্রীয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় মোহিত হয়ে যান। দিনলিপির ছত্রে ছত্রে যে ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীকে দেখা যায় তারা শুধুই সংঘাত-হিংসা ও বিভিন্নতার কথা বলে না। বরং হিন্দু মুসলমান যৌথ ভাবে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছে, নাগরিক সমাজ বার বার বলেছে ‘মতদ্বৈততা’ ভারতে ‘মতদ্বৈরথ’ নয়। আজ ভারতের চিত্রাবলির কোলাজ দেখে মনে হচ্ছে বহুকাঙ্ক্ষিত সেই স্ব-রাজ বা নিজেদের শাসন পেলাম কোথায়?

স্বাধীনতার পর সত্তর বছর কেটে গেল, দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের নেতারা ভারতবর্ষকেই জানতে চাইলেন না। শুধু তাঁরা ভোটে জিততে চান। দেশকে জানার জন্য প্রয়োজন ছিল দেশের আমজনতার সম্পর্কে সংবেদনা। সেই সংবেদনা প্রকাশের মানে দলিতের বাসভবনে গিয়ে ক্যামেরার সামনে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ‘ইভেন্ট’ তৈরি নয়। এত বছর পরও রাজনৈতিক সংঘাতের পাশাপাশি এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এটা বলা যাবে না যে সাধারণ হিন্দু পরিচয়টি আসলে সম্পূর্ণ ভৌগোলিক, কোনওভাবেই ধর্মীয় নয়। সেই ভৌগোলিক পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ করতেই হবে। বলতে হবে, আর্য ঋষিদের যুগটাই হিন্দু যুগ। এ ভাবে আর্য=হিন্দু বলাটা সত্যের অপলাপ নয়? জোর করে হিন্দুত্বের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য হিন্দিভাষাকে চাপিয়ে দেওয়াও তো গণতান্ত্রিক নয়, একনায়কতন্ত্রের মানসিকতা।

ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কংগ্রেসের মতো জাতীয় দলের অবক্ষয়, বিজেপি তথা আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সাভারকর ও তাঁর অনুগামী বি এস মুঞ্জে, মুসলমান বিরোধিতার জন্য ‘জাতিযুদ্ধের’ সমাধান সূত্র দেন, জাতিযুদ্ধের মাধ্যমে হিন্দু সমাজকে সুসংহত করতে চান। ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্বের এই ধারাটি আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পর। প্রথম তিন দিনেই ৭৯৫ জন মানুষ নিহত হন। আজ এত বছর পর সেই মেরুকরণের ধারা আরও শক্তিশালী হয়েছে। বহু রাজ্যে মানুষের সমর্থনও লাভ করেছে। সংঘাত ও হিংসা বাড়ছে।

এ এক ধরনের জনপ্রিয় ফ্যাসিবাদী সামাজিক মনস্তত্ত্ব। ফ্যাসিবাদ কিন্তু আসলে সবসময় পুঁজিবাদী ধারণা নয়। বরং ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী উদারনীতির বিরুদ্ধে। ঐতিহাসিক আর্থার রোজেনবার্গ, ১৯২৮ সালে প্রথম কমিউনিস্টদের সতর্ক করে বলেন একনায়কতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদ জনগণের আন্দোলন হিসাবে একটি দেশে গড়ে উঠতে পারে। ১৯৩৭ সালে সাভারকরও হিন্দু মহাসভার দায়িত্ব নিয়ে এই সংগঠনের চরিত্র বদলে দেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বিরোধী চরিত্র দিয়ে ‘মাস মুভমেন্ট’ গড়ে তুলতে চান তিনি। এই ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলনে নিম্নবর্গ সমাজ যোগ দেয়। ইতিহাসবিদরা বলেন, এ হল ‘সাবঅলটার্ন ফ্যাসিবাদ’।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার একনায়কতন্ত্রের মানসিকতা সামগ্রিক ভাবে এক অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি করে। অসহিষ্ণুতা জন্ম দেয় সংঘাত, তথা হিংসার। গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর হল ভিন্নমত। ভিন্ন ভাবনার উপর স্টিম রোলার চাপানোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই তো স্বৈরতন্ত্র। ভারত নামক দেশটির সভ্যতাই একক অখণ্ড কি না, তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। এত উপ-জাতীয়তা, আঞ্চলিক স্বকীয়তার লড়াইও তো সত্য। অখণ্ড রাষ্ট্র নামক এক মোক্ষম দাওয়াই দিয়ে অযোধ্যা, শ্রীনগর আর মেঘালয়, সব ভিন্নতাকে বলপূর্বক অভিন্ন অ্যাসর্টেড চকোলেটে পরিণত করা সম্ভব? সেটা করার চেষ্টা হচ্ছে বলেই চাপা ভিন্নতা বিদ্রোহের জন্ম দিচ্ছে নানা প্রান্তে।

এই সংঘাতের নানা রূপ। কখনও হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় মেরুকরণ। কখনও ব্রাহ্মণ-দলিত জাতপাতের সংঘাত। কখনও কেন্দ্র বনাম রাজ্য ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা। কখনও শহর বনাম গ্রাম, কখনও শিল্প বনাম কৃষি, কখনও ধনী দরিদ্রের আর্থিক অসাম্য। অতীত আর বর্তমানের মধ্যে কথোপকথনই ইতিহাস। অতীতের সব কিছুই সুন্দর, সব কিছুই শুভ, এমন মোহে পিছলে যাচ্ছি না। আবার অতীতের ভারত মানেই শুধু নেতি নেতি তাও নয়। বরং সমস্ত নেতির মধ্যে থেকে ভারত চেতনা এক সুদীর্ঘ সুষুপ্তির শেষে এক জাগ্রত চৈতন্যে বর্তমানকে ভাল করে দেখার চেষ্টা। এমনটাই তো ভারতসন্ধানী নেহরু লিখেছিলেন। ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধান তো এমনই এক ভারত নির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

এমনও নয়, শুধু ভারতেই হতাশা। সমগ্র বিশ্বেই ব্যক্তিগত পরিসর আজ অবলুপ্ত হচ্ছে। জর্জ অরওয়েল ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে এক আধিপত্যকামী নজরদারি রাষ্ট্রীয় সমাজব্যবস্থার বিষণ্ণ কাহিনী শুনিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে মাইক্রোসফট-এর সিইও স্কট ম্যাকেনেলি ঘোষণা করেন ‘প্রাইভেসি ইজ ডেড’। ভারতেও এখন ব্যক্তিস্বাধীনতার মৃত্যুগাথা রচনা হয়েছে। এসো আমরা সমবেত ভাবে একনায়কতন্ত্রের, রাষ্ট্রবাদের জয়ধ্বনি দিই। বহুত্ববাদ? সে আবার কী? কাঁঠালের আমসত্ত্ব?

খণ্ড থেকে মানুষের অখণ্ডতার প্রাপ্তি হয় সংঘাতে নয়, ঐক্য আর সমন্বয়ে। দ্বন্দ্ব সত্য। কিন্তু দ্বন্দ্ব থেকে ভারতের মুক্তি সম্ভব ঐক্যের সাধনায়। এই বহুত্ববাদী সংস্কৃতি-ধন্য ভারতে মেলানোর চেষ্টা না করে শুধু শিরা ফুলিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে, বুকের ছাতি ও পেশি প্রদর্শন করে বীররসগাথা রচনার চেষ্টা হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে। শেষ পর্যন্ত গোটা দেশটাই কি পরিণত হবে লাশকাটা ঘরে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE