কেন্দ্রীয় সরকারের মহাত্মা গাঁধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প, যা এমজিএনরেগা বা একশো দিনের কাজ হিসেবে পরিচিত, মহিলাদের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাঁদের কাছে গৃহকর্মের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মে যোগদানের এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। এমনিতে এমজিএনরেগা নারীর উন্নয়ন বা তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রকল্প নয়। কিন্তু এর বিশেষ কিছু দিক রয়েছে, যার জন্য মহিলাদের কাছে এই প্রকল্পের একটা বিশেষ আবেদন আছে। একশো দিনের কাজের আইনে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ন্যূনতম তেত্রিশ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ কাজের একটা সরকারি তকমা থাকায় মহিলাদের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। তা ছাড়া, এই কাজের সময় মূলত সকালবেলা হওয়ায় এবং এই সময়ের মধ্যেও যথেষ্ট নমনীয়তা থাকায় গ্রামের মহিলারা এই কাজ করতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সত্যিই কি গ্রামের সকল কাজপ্রত্যাশী মহিলারা কাজ পাচ্ছেন এই প্রকল্পে?
সম্প্রতি নদিয়া জেলার কয়েকটি ব্লকের ৫০০ জন মহিলার উপর একটি গবেষণামূলক সমীক্ষা করা হয়েছিল। বিগত কয়েক বছরে নদিয়ার সামগ্রিক স্তরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ২০১৪-১৫ আর্থিক বছর থেকে পরবর্তী প্রতি বছরই একশো দিনের কাজে মহিলাদের উপস্থিতি গড়ে ৫০ শতাংশের উপর, যা তাঁদের জন্য যে ন্যূনতম হার নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি। পাশাপাশি এই তথ্য আর একটি বিষয় উপস্থাপিত করে যে নদিয়া জেলার সাপেক্ষে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের হাজিরা এ কাজে বেশি, লিঙ্গগত সাম্যের নিরিখে যা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আমরা যখন সমীক্ষার অনুস্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করি, তখন একটি মিশ্র চিত্র পাই। নমুনার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ মহিলার গত তিন বছরের গড় কর্মদিবস ছিল ৩১-১০০ দিন, যার মধ্যে অধিকাংশ মহিলাই গড়ে ৫০ দিনের আশেপাশে কাজ পেয়েছেন। আবার বাকি ৩০ শতাংশ মহিলা ওই সময় গড়ে ০-৩০ দিন কাজ পেয়েছেন। প্রশ্ন জাগে যে কেন তাঁরা এত কম কাজ পাচ্ছেন?
কিছু ক্ষেত্রে এর অন্যতম কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সমীক্ষার সময় এমন বেশ কিছু সাধারণ জাতিভুক্ত পরিবারে যাওয়া হয়েছে, যেখানে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা তাঁত বোনা, নিজের কৃষিজমির দেখাশোনা প্রভৃতি বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকে একশো দিনের কাজ করেন। কিন্তু বাড়ির মহিলাদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাঁদের মতে, বাড়ির মহিলারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটি কাটবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এর সঙ্গে সামাজিক সম্মান জড়িয়ে আছে। অন্য দিকে রয়েছে সামাজিক বৈষম্য। এমজিএনরেগায় পরিবার পিছু একটি জব কার্ড থাকে, যেটি বাড়ির সকল প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের সম্মিলিত ভাবে বছরে একশো দিনের কাজের সত্ত্বাধিকার দেয়। এ ক্ষেত্রে এক জনের কাজ প্রাপ্তি স্বভাবতই অন্যের কাছে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বাড়ির পুরুষ সদস্য কাজ পেলে মহিলা সদস্য কাজের অধিকার হারায়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, একটি বাড়িতে যদি একাধিক পুরুষ সদস্য থাকেন কিংবা বাড়ির একমাত্র পুরুষ সদস্যের যদি অন্যান্য কাজে ব্যস্ততা কম থাকে, তবে বাড়ির মহিলাদের কাজ পাওয়ার হার ভীষণ ভাবে কমে যায়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কাজে পুরুষের প্রাধান্য সবার আগে।
এমজিএনরেগায় বলা আছে কাজের জায়গায় পানীয় জল, প্রাথমিক শুশ্রূষা, ক্রেশ-এর ব্যবস্থা, অস্থায়ী আচ্ছাদন, অস্থায়ী শৌচাগার প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ কাজের জায়গায় কেবল পানীয় জল বা প্রাথমিক শুশ্রূষা ব্যতীত আর কোনও ব্যবস্থা সে অর্থে থাকে না। ফলে অনেকেরই ইচ্ছে থাকলেও কাজে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না।
অনেক সময় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব মহিলাদের কম কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। এই সমস্যা অবশ্য নারী-পুরুষ উভয়েরই। একশো দিনের কাজ পেতে গেলে প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট ফর্মে পঞ্চায়েতের কাছে আবেদন জানাতে হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই রীতি মানা হয় না। কাজ প্রদানের সময়ে রাজনৈতিক পরিচিতি বড় হয়ে ওঠে। যে রাজনৈতিক দল যে পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় রয়েছে, তারা তাদের অনুগতদের কাজ প্রদানে বিশেষ আগ্রহী। প্রশাসনিক স্তরেও এই পক্ষপাতিত্ব কার্যকর। এও এক ধরনের প্রশাসনিক র্যাশনিং। প্রান্তিক মানুষদের বেশি করে কর্মপ্রদান, স্থানীয় কর্মহীনতায় স্থানান্তর গমন রোধ প্রভৃতি উদ্দেশ্য নিয়ে একশো দিনের কাজের আইন রচিত হয়েছিল। কিন্তু র্যাশনিং-এর জন্য প্রকল্পটি দিশা হারাচ্ছে।
গ্রামীণ রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক, ক্ষতি নেই, তবে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটা সুস্থ রূপ পরিগ্রহ করবে, এটাই বাঞ্ছনীয়। আর এর জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক সংবেদনশীলতা। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সেটাই সব চেয়ে বেশি কাম্য।
সুধীরঞ্জন লাহিড়ি মহাবিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy