Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

ভবিষ্যৎটা সম্ভবত দেখতে পাচ্ছেন না ট্রাম্প

নির্বাচনী প্রচারে যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ঘোষণা করেছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেই নীতিতেই সঙ্কীর্ণতা দেখেছিলেন অনেকে। আগে মার্কিন নাগরিকদের প্রয়োজনীয়তা মেটানো হবে, তার পরে বহির্বিশ্বের কথা ভাবা হবে— খুব জোর গলায় ঘোষণা করছিলেন ট্রাম্প।

অত্যন্ত স্বাভাবিক কথাকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করার মধ্যেই অপরিণতমনস্কতার প্রমাণ দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।—ফাইল চিত্র।

অত্যন্ত স্বাভাবিক কথাকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করার মধ্যেই অপরিণতমনস্কতার প্রমাণ দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।—ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৫৮
Share: Save:

মোড়লকে গাঁয়ের কেউই আর মানছেন না, এমন পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেই তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে আমেরিকার জন্য, এমনটা বলাও খুব বাড়াবাড়ি হবে। তবে মার্কিন বিদেশ নীতিতে কর্তৃত্ববাদের দাপট যে ভাবে বাড়ছে দিন দিন, তাতে মোড়লি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে।

তার সুবৃহৎ অর্থনীতি, যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার সবিশেষ অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক বহুত্বের এক আদর্শ মিশ্রণ-পাত্র হিসেবে তার নিজস্ব ভূখণ্ডের পরিচিতি এবং সর্বোপরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি হয়ে ওঠা— সব মিলিয়েই আমেরিকা পৃথিবীর নেতা। যে ভাবেই হোক, সে স্থান দশকের পর দশক ধরে অক্ষুণ্ণ রেখেছে দেশটা। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে আমেরিকা একচ্ছত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসির বর্তমান অধীশ্বররা সম্ভবত কোথাও একটু ভুল করে ফেলছেন এ বার। যে কারণগুলোর জন্য আমেরিকা শ্রেষ্ঠ আসনে পৌঁছেছে, সেই কারণগুলোকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। ট্রাম্প সম্ভবত শুধু শ্রেষ্ঠত্বের চোখধাঁধানো উদ্যানটা দেখতে পাচ্ছেন। উদ্যানটা টিকে রয়েছে যে স্তম্ভগুলোর উপরে, সেগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন না। শক্তি ও ঐশ্বর্যের শ্লাঘায় বুঁদ হয়ে থাকা সম্রাটের মতো কঠোর থেকে কঠোরতর করে তুলতে চাইছেন বজ্রমুষ্টি। প্রচণ্ড হুঙ্কার দিচ্ছেন। সে হুঙ্কারে নিজের সাম্রাজ্যের ধারক স্তম্ভগুলোর ভিতই কাঁপিয়ে দিচ্ছেন।

নির্বাচনী প্রচারে যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ঘোষণা করেছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেই নীতিতেই সঙ্কীর্ণতা দেখেছিলেন অনেকে। আগে মার্কিন নাগরিকদের প্রয়োজনীয়তা মেটানো হবে, তার পরে বহির্বিশ্বের কথা ভাবা হবে— খুব জোর গলায় ঘোষণা করছিলেন ট্রাম্প। অত্যন্ত স্বাভাবিক কথাকে এমন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করার মধ্যেই অপরিণতমনস্কতার প্রমাণ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। আমার জন্মদাত্রীকেই আমি সর্বাগ্রে মা বলে ডাকব, তার পরে ভাবব অন্য কাউকে মা বলে ডাকা যায় কি না— এ কথা আমরা কেউ ফলাও করে বলি না। কিন্তু সকলেই জানেন, এ অমোঘ। ঠিক তেমন ভাবেই সকলেই জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে থাকা যে কোনও ব্যক্তি মার্কিন স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবেন, এও অমোঘ। আবহে উগ্রতা রেখে তার উচ্চকিত উচ্চারণের প্রয়োজন পড়ে না। উচ্চারণটা করেই বরং ট্রাম্প বুঝিয়েছিলেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ওয়াশিংটন ডিসির আচরণে পরিণতমনস্কতার অভাব পরিস্ফূট হতে পারে। হচ্ছেও তাই।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

আমেরিকার দরজা গোটা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত— এই ধারণা ট্রাম্প অনেক দিন আগেই চুরমার করে দিয়েছেন। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে উদ্ভুত যে কোনও সঙ্কটের নিরসনে আমেরিকাই সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে— সে ভাবমূর্তিও ফিকে ট্রাম্প জমানায়। আমেরিকার এই আচমকা আত্মকেন্দ্রিকতায় যে আমেরিকার অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়েছে, এমন কোনও আভাসও নেই। বরং চিনের সঙ্গে শুরু হওয়া শুল্কযুদ্ধে বেশ কিছুটা ধাক্কার মুখে আমেরিকা। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্বের আসনটা ধারণ করে রয়েছে যে স্তম্ভগুলো, সেগুলোর অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ভেবে থাকেন, সামরিক সক্ষমতা নামক স্তম্ভটাই যথেষ্ট, আর কিছু জরুরি নয়, তা হলে বড্ড ভুল হয়ে যাচ্ছে।

রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনায় চিনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা। রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা তো রয়েইছে। ইরানের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা বজ্রকঠিন করেছেন ট্রাম্প।

এতেই শেষ নয় কিন্তু। এই দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকার রেষারেষি দীর্ঘ দিনের। তাই তাদের সঙ্গে বৈরিতা বাড়লেও ক্ষতিবৃদ্ধি খুব বেশি হয় না। ক্ষতিবৃদ্ধি সাংঘাতিক হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যখন মিত্রদের সঙ্গেও সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হতে থাকে। ট্রাম্প প্রশাসন সে পথেই হাঁটছে।

আরও পড়ুন
ইরানের তেল: দিল্লি কোপে পড়তে পারে নিষেধাজ্ঞার, ইঙ্গিত ওয়াশিংটনের

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত যে সব দেশ, তাদের সঙ্গেও ওয়াশিংটন ডিসির তিক্ততা বেনজির পর্যায়ে। এ বার ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের অগ্রগতিও প্রশ্নচিহ্নের মুখে।

গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তথা দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র দেশ ভারতই। বৃহৎ এশীয় শক্তিগুলির মধ্যে চিন মোটেই আমেরিকার কাছের নয়। বৃহৎ এশীয় শক্তিগুলির মধ্যে ভারত ও জাপান আমেরিকার বন্ধু।

কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র এবং ইরানের কাছ থেকে তেল কিনে ভারতও এখন আমেরিকার রোষে। রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক বা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে যে সব দেশের, তাদের সকলের বিরুদ্ধেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা। ভারতকেও সেই নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি দেওয়া ছিল। তা না মেনে ভারত যেহেতু ইরানের কাছ থেকে খনিজ তেল ও রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনছে, সে হেতু ভারতকেও ছাড় দেবে না আমেরিকা, এমন ইঙ্গিত দেওয়া শুরু হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি এবং চিন-পাকিস্তান জোটের কথা মাথায় রেখে ভারতকে ছাড় দেওয়া হোক, ইরানের থেকে তেল ও রাশিয়ার থেকে অস্ত্র কেনা ভারতের জন্য এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি--- কূটনৈতিক স্তরে এই বার্তা আমেরিকাকে দিয়েছে ভারত। ট্রাম্প প্রশাসনের একাংশ ভারতের প্রতি নরম মনোভাব দেখানোর পক্ষে তথা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির বিপক্ষে সওয়ালও করছে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে এখন নিষেধাজ্ঞার শাসানি শোনা যাচ্ছে|

অত্যন্ত অপরিণত কূটনীতির পরিচয় দিচ্ছে আমেরিকা। পরিস্থিতি ভেদে নীতি বা কৌশল বদলানোর মতো নমনীয়তার সংস্থান রাখা সফল কূটনীতির অঙ্গ। আমেরিকা সে কথা বোধহয় ভুলে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগর থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অংশে চিন যে ভাবে দাপট বাড়াচ্ছে, তা রুখতেই ভারতের সঙ্গে সখ্য ক্রমশ বাড়িয়েছে আমেরিকা। কারণ, শুধু আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্ব জানে, এশীয় জলপথে চিনের দাপটের বিরুদ্ধে মাথা তোলার মতো একমাত্র শক্তি ভারতই। পারস্পরিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই যখন কাছাকাছি আসা, তখন পরস্পরের বাধ্যবাধকতাগুলোও বোঝা জরুরি। চিনের সঙ্গে ভারতের সমীকরণ মোটেই ভাল নয়। অতএব, চিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কোন পথে এগোবে, তা ভারতই স্থির করবে— এই কথার কি কোনও যুক্তি থাকতে পারে? পারে না। ঠিক সে ভাবেই ভারত-রাশিয়া বা ভারত-ইরান সম্পর্কও আমেরিকার অঙ্গুলি নির্দেশে চলবে না, এ কথা ট্রাম্প প্রশাসনের বোঝা উচিত। না বুঝলে খুব ইতিবাচক দিন আমেরিকার অপেক্ষায় থাকবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE