অমর একুশের অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কার ৩০তম অধিবেশনে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেন।
এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত বাঙালি জাতির কাছে এক গৌরবময় অর্জন। মূলত বাংলাদেশের প্রচেষ্টাতেই এটা সম্ভব হয়। ওপার বাংলার অধিবাসীরা প্রাণের আহুতিতে মাতৃভাষার অধিকার অর্জন করেছিল। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বারবার গর্জে উঠেছে, আন্দোলন করেছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু শাসকের রক্তচক্ষুর কাছে মাথা নত করেনি। মেনে নেয়নি অন্য ভাষাকে তাঁদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়াকে। তাই প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশ্ববাসী ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করে।
বাংলা ভাষার গৌরব ধরে রাখার এই লড়াই ওপার বাংলা শুরু করেছিল পাকিস্তান গঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তৈরি হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণপরিষদ তার রাষ্ট্রভাষা নির্ধারিত করতে বসে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের গোড়ায়। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যানে লোক তখন ছয় কোটি নব্বই লক্ষ। বাঙালি চার কোটি চল্লিশ লক্ষ। তবু ইংরেজের করা ভারত শাসন আইনের সংশোধন করতে বসে কুড়ি নম্বর উপধারাতে ইংরেজির পরে উর্দুকে বেছে নেন গণপরিষদের সদস্যরা। সমগ্র পাকিস্তানের সাত শতাংশ লোকও তখন সে ভাষা বলে না। বাংলা বলেন ৫৬ শতাংশ পাকিস্তানবাসী।
কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদের কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানান। বলা বাহুল্য সে দাবি খারিজ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করতে পারেননি যে এ দাবি কেবল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নয়, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের।
এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম বা কর্ম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে বলা হয় যে অ্যাসেম্বলির সদস্যরা হয় ইংরেজি, নয় উর্দুতে বক্তব্য রাখবেন। এর প্রতিবাদে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট চলে। ২১ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিন্না। তিনি ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে এক বক্তৃতায় স্পষ্ট করে দেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর পরে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি একই কথা বলেন। তার পরে শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানা ভাবে উর্দু ভাষা আরোপের চেষ্টা আর তা অস্বীকারের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি সমগ্র পাকিস্তানের মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ইতস্তত জ্বলতে থাকা স্ফুলিঙ্গে এ বক্তব্য যেন ঘৃতাহুতি দিল। স্ফুলিঙ্গ ক্রমে পরিণত হল আগুনে, যা ক্রমশ দাবানল হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সমবেত হতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে ছিল বেশ কিছু পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু হাজার হাজার ছাত্রের সমাবেশ এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। ঢেউয়ের মতো দলে দলে ছাত্ররা গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে পুলিশের গাড়িতে উঠেছিল। ছাত্রীদের পুলিশ গ্রেফতার করেনি।
ছাত্ররা এগোতে চেয়েছিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের দিকে। কিন্তু পুলিশ তাদের মেডিক্যাল কলেজের গেটের কাছে আটকে দিয়েছিল। এর পরে কিছু বিক্ষিপ্ত হিংসামুলক ঘটনা ঘটতে থাকে। ৩টে নাগাদ ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। পুলিশ মেডিক্যাল কলেজের গেটের ভেতর ঢুকে এলোপাথাড়ি লাঠি চালায়। ছাত্রেরা ইট পাটকেল ছুড়ে আত্মরক্ষা করে।
৩টে থেকে সওয়া ৩টের মধ্যে হঠাৎই মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের গেটের ভেতরে ঢুকে গুলি ছোড়ে পুলিশ। দু’দফায় মোট ২৭ রাউন্ড গুলি চলে। চার জন সে দিনই নিহত হন। প্রায় দুশো ছাত্র আহত হন।
একুশের শহিদ ছিলেন রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম। ২২ ফেব্রুয়ারি শহিদদের সংখ্যা আরও বাড়ে। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েক জন মারা যান। পুলিশ মৃতদেহ আত্মীয়দের হাতে সমর্পণ করেনি। পাকিস্তানের পুলিশ তাদের শাহাদাতের সমস্ত স্মারক নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকেই শহিদদের স্মরণে নির্মিত হতে শুরু করে শহিদ মিনার। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এটিকে ভেঙে দেয়। আন্দোলন কিন্তু থেমে থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জেদের কাছে হার মেনে ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাধ্য হয় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। এই দিনটি বাঙালিদের নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে শেখায়। এক মাস ধরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। একুশে পদক দেওয়া হয় ভাষা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে পূর্ব-পশ্চিম উভয় বাংলা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যন্ত্রণাময় অথচ গৌরবময় এই দিনটি বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মাতৃভাষার সাথে তারা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের কথা।
শিক্ষিকা নওপুকুরিয়া জানকীনাথ-যদুনাথ উচ্চ বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy