Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অর্থনীতির রাজনীতি

যুদ্ধটি প্রকৃত প্রস্তাবে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার, এক মেরু বিশ্বে অর্থনৈতিক মহাশক্তি হইয়া উঠিবার। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চিনই মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৮ ০০:৩৭
Share: Save:

বিশ্বযুদ্ধ। মহাকবি আপত্তি করিবেন, কিন্তু নামে আসিয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের বাণিজ্য-যুদ্ধকে অন্য কোনও নামে ডাকা অসম্ভব। দুই দেশ পরস্পরের পণ্যে দিনে দ্বিগুণ রাত্রিতে চতুর্গুণ আমদানি শুল্ক আরোপ করিতেছে, শুধু সেই কারণেই ইহা বিশ্বযুদ্ধ নহে। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় কার্যত কোনও দেশের পক্ষেই এই দ্বৈরথের প্রভাব এড়াইয়া থাকা সম্ভব নহে। কিন্তু, তাহাও ‘বিশ্বযুদ্ধ’ তকমাটির যথেষ্ট কারণ নহে। ইহা বিশ্বযুদ্ধ, কারণ বাণিজ্যিক দ্বৈরথ ইহার বহিরঙ্গমাত্র— গভীরে আছে আদি ও অকৃত্রিম ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাজাত সংঘাত। এবং, ইহা বিশ্বযুদ্ধ, কারণ কতখানি ক্ষয়ক্ষতির পর এই যুদ্ধ থামিবে, তাহা সম্ভবত
শি চিনফিংও জানেন না, ডোনাল্ড ট্রাম্পও নয়। কিন্তু যুদ্ধের আখ্যানে প্রবেশ করিবার পূর্বে একটি প্রাককথন প্রয়োজন। ট্রাম্প দুনিয়ার বাজারে ইতিমধ্যেই অপরিণামদর্শী হিসাবে নাম কিনিয়াছেন। তবে, সেই নামডাক প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই হইয়াছে। চিনের সহিত বাণিজ্য-যুদ্ধে নামিলে মার্কিন অর্থনীতির গায়েও যে যথেষ্ট আঁচ লাগিবে, ট্রাম্পসাহেব তাহার হিসাবটি ভুলেন নাই। তিনি এমন এক সময়ে যুদ্ধের ভেরি বাজাইলেন, যখন বহু বৎসর পর মার্কিন অর্থনীতি সুস্বাস্থ্যে ফিরিয়াছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়াছে। ফলে, দেশে উৎপাদিত পণ্য দেশেই বেচিবার সুযোগ আছে। অর্থাৎ, যুদ্ধের ধাক্কা সর্বাপেক্ষা কম লাগিবে, এমন সময়টিকেই তিনি যুদ্ধ ঘোষণার জন্য বাছিয়াছেন।

যুদ্ধটি প্রকৃত প্রস্তাবে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার, এক মেরু বিশ্বে অর্থনৈতিক মহাশক্তি হইয়া উঠিবার। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চিনই মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। পূর্ব চিন সাগর হইতে দক্ষিণ চিন সাগর, এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জু়ড়িয়া চিন যে ভঙ্গিতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতেছে, যে ভাবে আফ্রিকায় নব-উপনিবেশ স্থাপন করিতেছে, তাহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। উপরন্তু, চিনের অর্থনীতিও চরিত্র বদলাইতেছে। তাহারা আর দুনিয়ার কারখানা হইয়া থাকিতে নারাজ। বরং, নব্য প্রযুক্তির বাজারে বিশ্বশক্তি হইয়া উঠিতে সরকার কোটি কোটি ডলার ব্যয় করিতেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বাড়াইয়া স্বয়ংসম্পূর্ণ হইতে চেষ্টা করিতেছে। ইতিহাসে এই মুহূর্তটি গুরুত্বপূর্ণ— প্রথম বিশ্বের কাজ চালানোর উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি হইতে চিন উত্তীর্ণ হইতেছে চালক বিশ্বশক্তিতে। এই মুহূর্তে তাহাকে ঠেকাইতে না পারিলে খেলাটি আর আমেরিকার নাগালে থাকিবে না। ঠিক এই মুহূর্তেই যে ট্রাম্পসাহেবের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিটির সহিত সেই বৃহত্তর যুদ্ধের গল্পটি সমানুবর্তী হইয়া উঠিল, তাহা নিছক কি সমাপতন? না কি, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর উগ্র অপরিশীলিত জাতীয়তাবাদ জটিলতর, বৃহত্তর আর্থিক সংঘাতেরই শিশুপাঠ্য রূপ?

গোটা দুনিয়ার উৎপাদন এই যুদ্ধে ধাক্কা খাইবে। কারণ, আন্তর্জাতিক পুঁজির চক্রে শুধু চিন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নহে, কমবেশি সব দেশই এখন বাঁধা। ভারতেরও ধাক্কা লাগিবে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর বর্ধিত আমদানি শুল্কই যেমন ভারতকে প্রভাবিত করিতেছে। সুরেশ প্রভু ওয়াশিংটন হইতে জানাইয়াছিলেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হইবে। তিনি দিল্লিতে পা রাখিতে না রাখিতেই ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে জানাইয়া দিল, তাহারাও পাল্টা শুল্কবৃদ্ধির পথে হাঁটিতেছে। বিপজ্জনক অবস্থান। কারণ, যুদ্ধটি যে মাপের, ভারত সেখানে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। তাহার বাজারের আয়তনটি বিপুল, সন্দেহ নাই, কিন্তু এই যুদ্ধ তাহার তুলনাতেও ঢের বড়। আপাতত কোনও পক্ষ না লইয়া চুপচাপ জল মাপিয়া যাওয়াই একমাত্র নীতি হওয়া বিধেয়। কারণ, উলুখাগড়ার প্রাণ যাওয়ার কথাটি নেহাত কথার কথা নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economical politics US China Trade War
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE