Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দেশপ্রেমের প্রচার বা যুদ্ধ করে ভোটে জেতা যায় না

১৯৬২ সালে তৃতীয় সাধারণ নিবার্চন হয়েছিল চিন-ভারত যুদ্ধের আগে। সে যুদ্ধ কোনও গৌরব বহন করে আনতে পারেনি। তবে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পেরেছিলাম। লিখছেন স্বদেশ রায়১৯৬২ সালে তৃতীয় সাধারণ নিবার্চন হয়েছিল চিন-ভারত যুদ্ধের আগে। সে যুদ্ধ কোনও গৌরব বহন করে আনতে পারেনি। তবে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পেরেছিলাম। লিখছেন স্বদেশ রায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৯
Share: Save:

পুলওয়ামার জঙ্গি হানায় ৪৯ জন জওয়ান প্রাণ দিলেন। মাতৃভূমি রক্ষায়। বালাকোটের সার্জিকেল স্ট্রাইক সত্যি কি কারও জয়ের মালা গাঁথবে? জওয়ানের রক্তজবা সমাবৃত দেহ, যেন ওই প্রশ্নটাই করেছিল। আসমুদ্র হিমাচল সবর্ত্রই দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে গিয়েছে। আমাদের দেশপ্রেমে টান পড়লেই সীমান্ত যেন দায়িত্ব নেয়। আর দায়িত্ব নেয় ভারতীয় ক্রিকেটদল। ভারত জিতলে তবেই জাতীয় পতাকা হাতে দেশের জন্য জয়ধ্বনি দেওয়া যায়। বাকি সময় আমাদের দেশপ্রেম ঘুমিয়ে থাকে।

ক্রীড়াঙ্গন ও রণাঙ্গন থেকে প্রাপ্ত দেশপ্রেমের আবেগ শাসকদলকে এগিয়ে দেবে কতটা? ভাষা না জানলেও সুর মানুষের মনকে স্পর্শ করে। আমাদের দেশপ্রেম না জানা ভাষার একটি গানের সুর। দেশপ্রেমের এ সুর সকলের। সপ্তদশ লোকসভা নিবার্চন, যুদ্ধ থেকে পাওয়া দেশপ্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি? দেশপ্রেমের আলোতে ঢেকে আছে আমাদের অনেক দুঃখ, অনেক অভাব। ওরা রাতের তারার মতো আমাদের মনের আকাশে জেগেই আছে।

যুদ্ধোত্তর সময়ে ভারতের শাসকদল নিবার্চনে কতটুকু সুবিধা পেয়েছে, তা নিয়ে একটা আলোচনা চলতেই পারে। যুদ্ধ থেকে নিবার্চনী বৈতরণি পারের নজির কী আছে, তা এক বার ফিরে দেখি।

১৯৬২ সালে তৃতীয় সাধারণ নিবার্চন হয়েছিল চিন-ভারত যুদ্ধের আগে। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল অক্টোবরের ২০ তারিখে। সে যুদ্ধ কোনও গৌরব বহন করে আনতে পারেনি। তবে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পেরেছিলাম। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর শাসনের পনেরো মাসে প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে সমীহ আদায় করতে পেরেছিলেন। সে দিনের দেশপ্রেমের সঙ্গে আজকের দেশপ্রেমের মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সে দিনও দেশপ্রেমের জোয়ারে দেশ ভেসে গিয়েছিল। আর এ বার দেশপ্রেমের সঙ্গে কাউকে কাউকে পাকিস্তানের সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চলছে।

তার পর এল ১৯৬৭ সালের চতুর্থ নিবার্চন, লোকসভা এবং বিধানসভা। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী কংগ্রেসকে খুব বড় সাফল্য এনে দিতে পেরেছিলেন? ৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী লাহোরের ইছগিল খাল অতিক্রম করে পাক ভূখণ্ডে ভারতের জাতীয় পতাকা প্রোথিত করেছিল। অপরাজেয় প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস ও পুরনো ন্যাট বিমান দিয়ে স্যাবারজেটের পতন দেখেছিল দেশবাসী। এই যুদ্ধের পরাক্রম ১৯৬৭ সালের নিবার্চনে প্রতিফলিত হল না। লোকসভার ৫২০ আসনের মধ্যে কোনও মতে ২৮৩ টি আসনে জয়লাভ করে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ইন্দিরা সরকার গঠন করেন। কেরল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সহ নয়টি রাজ্য কংগ্রেস ক্ষমতা হারায়। কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী কে কামরাজ, এস কে পাতিল, অতুল্য ঘোষ পরাজিত হন।

১৯৭১ সালে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গাঁধীকে লোকসভার অন্তর্বর্তী নিবার্চন ডাকতে হয়েছিল। গরিবি হঠাও— এর ডাক দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের নিবার্চনের পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে একে একে আযভট্ট উৎক্ষেপণ, পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভারতকে বিশ্বের শক্তিধর দেশ হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

দেশের অভ্যন্তরে দেশপ্রেমের স্রোত প্রবাহিত হলেও ১৯৭৫ সালে ইন্দিরাকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছিল। দুর্নীতি ভ্রষ্টাচার বিরোধী জয়প্রকাশ আন্দোলনের জন্য কংগ্রেসকে পিছু হটতে হয়েছিল। তাই ভোট পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের নিবার্চনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হল। কেন্দ্রে প্রথম কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। ইন্দিরা ও সঞ্জয় পরাজিত হলেন। দেশের মানুষের ক্ষোভ, স্বাধীনতা হরণ ও গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা, দেশপ্রেমের জিগির তুলে পরাজয়কে ঠেকাতে পারেননি। দেশপ্রেম ও উন্নয়নের প্রলেপে মানুষের ক্ষোভ চাপা দেওয়া যায় না। তারই উদাহরণ ১৯৭৭।

১৯৭৭ সালের পর আরও কয়েকটি অন্তর্বর্তী নিবার্চন হয়েছিল। যথাক্রমে ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৯, ১৯৯১। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর জন্য ১৯৮৪ সালের নিবার্চন এগিয়ে আনা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের পর ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে ছিল অন্তর্বর্তী নির্বাচন। ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে কিছুটা যুদ্ধের দামামা বেজেছিল। ১৯৯৯ সালের যুদ্ধের আগে বাতালিক, দ্রাস, কার্গিলে এয়ার স্ট্রাইক করে কাশ্মীরকে মুক্ত করা হয়েছিল। দেশপ্রেমের প্রলেপে সেই নির্বাচনে প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ ও উন্নয়নমূলক বহু কাজ ২০০৪ সালে বাজপেয়ীকে ক্ষমতায় ফেরাতে পারেনি। গরিবি হটাও, ফিল গুড স্লোগান মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। তা কেবল বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়েছিল।

১৯৮৪ সালের নিবার্চনে মানুষ মনে-প্রাণে দেশরক্ষার কথা ভেবেছিল। ইন্দিরার মৃত্যুতে দেশ যখন সঙ্কটের মুখে পড়েছিল, তখন মানুষ নিজের সুরেই দেশপ্রেমের গান গেয়েছিল। দেশপ্রেম জাতীয়তাবোধ রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। দেশপ্রেমের প্রচার বা যুদ্ধ অন্তত ভোটে জিততে সাহায্য করে না।

তাই হল্লার রাজাকে বলতে ইচ্ছা হয়— ‘‘যুদ্ধ করে করবি কী, তা বল।’’

তবে, বসন্তের নিবার্চন প্রাক্ প্রচারের ফলাফল পেতে আমাদের গ্রীষ্মের দাবদাহে ২৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE