বহু দিনের পুরাতন এক প্রবচন রহিয়াছে, যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ। এই বহুব্যবহৃত কথাগুলির একটি অসুবিধা হইল, এইগুলি বহুব্যবহৃত। আর একটি সুবিধা হইল, কথাগুলি প্রায়ই প্রখর সত্য হিসাবে প্রতিভাত হয়। বামফ্রন্ট যখন এই রাজ্য শাসন করিত, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাহাদের দখলদারি লইয়া বিরোধীরা প্রায়ই সরব হইত। শিক্ষকদের নিজ দলের অনুগত সৈনিকে পরিণত করিবার জন্য, বহু শাসানি হুমকি ও চক্রান্তের অভিযোগ তাহাদের বিরুদ্ধে উঠিয়াছিল। কিন্তু বর্তমান শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এক কর্তা, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাহা শুরু করিয়াছেন, তাহা লঙ্কায় আসিয়া রাবণতর হইয়া উঠিবার উপাখ্যান। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এক শিক্ষককে তাঁহার ঘরে ঢুকিয়া তাঁহাকে চড় মারিয়া নিগ্রহ করিবার অভিযোগ উঠিয়াছে এক ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে। শিক্ষক নিগ্রহের প্রতিবাদে বাম নেতৃত্বাধীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (কুটা) এক সভা ডাকিয়াছেন, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে। সেইখানে গিয়া তাঁহার লাঞ্ছনার সবিস্তার বিবরণ দিবেন ওই শিক্ষক, জানিয়া রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলিয়াছেন, শিক্ষকের বামপন্থী, ডানপন্থী হইবে কেন? শিক্ষক কোন সংগঠনের সভায় যাইতে পারিবেন, আর কোথায় যাইতে পারিবেন না, এই বিষয়ে অনুশাসন জারি করিতে পারিলে শিক্ষামন্ত্রী বোধ করি বেজায় খুশি হইতেন। অবশ্য পূর্বেও তিনি এই মর্মে বারংবার বাণী বিকিরণ করিয়াছিলেন: তিনি যখন শিক্ষকদের বেতন দিতেছেন, তখন শিক্ষার সকল বিষয়ই নির্ধারণ করিয়া দিবার অধিকার তাঁহার রহিয়াছে। অর্থাৎ, শিক্ষকদের তিনি, বা তাঁহার দল, বেতনভোগী ভৃত্য হিসাবে দেখেন, যাহারা প্রভুর নিকট জোড়হস্তে বসিয়া থাকিবে ও আদেশ পালন করিয়া লাঙুল নাড়িবে। তাঁহার প্রশ্ন শুনিয়াও তাজ্জব হইতে হয়। শিক্ষকের ডান বা বামপন্থী হইবে না-ই বা কেন? এক শিক্ষক যে-কোনও পন্থার সমর্থক হইতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রী আসলে প্রশ্ন করেন নাই, নিতান্ত ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়াও মনে হয় না, সন্দেহ হয়, তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়াছেন। সম্ভবত বলিতে চাহিয়াছেন, এই রাজ্যের শিক্ষক কেবল পার্থপন্থী হইবেন।
যদি শিক্ষক ক্লাস না লইতেন, কলেজে আসিয়া অন্য কাজ করিতেন, বা কলেজে রাজনীতি করিতে গিয়া নিজ কর্তব্যে ফাঁকি দিতেন, তাহা হইলে শিক্ষামন্ত্রী সেই প্রসঙ্গে কথা বলিতেই পারিতেন। কিন্তু এই শিক্ষক তাঁহার নিগ্রহের বিরুদ্ধে একটি সভায় যাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। তাহাতে কোন আচরণবিধি লঙ্ঘিত হইয়াছে? একটি শিক্ষক সংগঠন সভা ডাকিলে, এক শিক্ষক সেইখানে যাইতেই পারেন। সেই সংগঠন ডান না বাম, তাহা শিক্ষামন্ত্রীই বা বিচার করিতেছেন কেন? আর, শিক্ষক তো এক জন ব্যক্তি, এক নাগরিক। তাঁহার মৌলিক অধিকার, যে-কোনও দলের যে-কোনও সভায় উপস্থিত থাকা, অনুরুদ্ধ হইলে ও সম্মত থাকিলে, বক্তব্য পেশ করা। নাগরিকের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ শুরু করিলে তো শিক্ষামন্ত্রী আর থামিতে পারিবেন না, দাদাগিরি ও মস্তানির নেশায়, শিক্ষক কী খাইবেন কী পরিবেন কেমন করিয়া হাঁটিবেন, সকল বিষয়েই তাঁহার উপদেশামৃত বর্ষণ শুরু হইবে। আসলে, কেন্দ্রে যেমন বিজেপি-বিরোধী কথাকে দেশদ্রোহ বলিয়া চালাইবার একটি প্রচারযন্ত্র চালু হইয়াছে, এই রাজ্যেও যাহা তৃণমূলবিরোধী তাহাই রাজ্যবিরোধী এমন ধারণা প্রচারের চেষ্টা হইতেছে। ইহাও এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র। শিক্ষামন্ত্রীকে প্রথমে বুঝিতে হইবে, শিক্ষকেরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, যে-কোনও দল বা মতকে সমর্থন করিতে পারেন। তাহার পর বুঝিতে হইবে, শিক্ষায়তনে সমস্যা হইলে সমাধানের দায় তাঁহার উপর বর্তায়, কিন্তু তাহা বলিয়া নূতন সমস্যা সৃষ্টির অধিকার তাঁহার নাই। তবে সর্বাগ্রে বুঝিতে হইবে, তাঁহার আচরণে শিক্ষার প্রতিফলন ঘটিতেছে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy