Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

শিক্ষকের কাজ

ভোটের কাজ হইতে নিষ্কৃতি তাঁহাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। ছাত্র ও অভিভাবকদেরও স্বস্তি। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কিছুটা উন্নত হইলেও, এখনও বহু প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়ে যথেষ্ট শিক্ষক নাই।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০৫
Share: Save:

শিক্ষকের কাজ শিক্ষকতা, মনে করাইয়া দিল কলকাতা হাই কোর্ট। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ শূন্য রাখিয়া শিক্ষক ভোটার তালিকার কাজ করিবেন কেন? বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন যখন নিয়মিত চলিতেছে, তখন শিক্ষককে ভোটের কাজে নিযুক্ত করিতে পারে না নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্তারাও তেমন নির্দেশ দিতে পারেন না। এই রায় শুনিয়া শিক্ষকমহল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিবেন, সন্দেহ নাই। ভোটের কাজ হইতে নিষ্কৃতি তাঁহাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। ছাত্র ও অভিভাবকদেরও স্বস্তি। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কিছুটা উন্নত হইলেও, এখনও বহু প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়ে যথেষ্ট শিক্ষক নাই। চার-পাঁচ জনের কাজের জন্য বরাদ্দ আছেন দুই বা তিন জন। তাঁহারাও ভোটের কাজে লাগিলে স্কুল কার্যত ছুটি হইয়া যায়, পঠনপাঠনে অঘোষিত বিরতি। বিচারপতি অনিয়মকে নিয়ম করিয়া তুলিবার এই সরকারি কার্যক্রমে যবনিকা টানিয়াছেন। তাহাতে সরকারের প্রতিও দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যায়। প্রথমত, মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অপর কোনও সরকারি কর্তব্য তাহার সমান মর্যাদা পাইতে পারে না। ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার মৌলিক অধিকার বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। ‘ভোটার তালিকা সংশোধন করিবার যথেষ্ট কর্মী নাই অতএব শিক্ষকদের কাজে লাগানো হইবে, পঠনপাঠন না হয় স্থগিত থাক’, সরকারি কর্তাদের এই মনোভাব সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারের প্রতি তাচ্ছিল্যের প্রকাশ। এই অবজ্ঞার কারণেই স্কুল চলাকালীন শিক্ষকদের সকাল এগারোটা হইতে বেলা চারটে অবধি নির্বাচনের কাজে নিযুক্ত করিতে বিজ্ঞপ্তি জারির সাহস করেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার।

এমন হইয়া থাকে, কারণ সরকারি কর্তাদের নিকট যে কোনও অধিকার হইয়া দাঁড়ায় ‘বরাদ্দ পাইবার অধিকার’। খাদ্যের অধিকার স্বীকৃত হইলে রন্ধনকর্মী ও রন্ধনসামগ্রীর বরাদ্দ টাকা মিলিবে। সে খাদ্যের সহিত পুষ্টির সংযোগ কতটুকু, সে প্রশ্ন উঠিতে পারে না। তথ্যের অধিকার আইন হইলে তথ্য কমিশনের সদস্য এবং করণিকদের বেতন বরাদ্দ হইবে। নাগরিকের হাতে প্রার্থিত তথ্য পৌঁছাইল কি না কে জানিতে চায়? সেই ভাবেই শিক্ষার অধিকার স্কুল ভবন, স্কুল শিক্ষক, পাঠ্যবই প্রভৃতির জন্য অর্থ মিলিবার অধিকারে পর্যবসিত হইয়াছে। পঠনপাঠন হইল কি না, জানিয়া সরকারের কাজ নাই। তাই উপদ্রুত এলাকার সরকারি স্কুলগুলি সামরিক বাহিনী দখল করিয়া বসিয়া থাকে মাসের পর মাস। এমনকি বড়সড় রাজনৈতিক কর্মসূচি হইলেও স্কুল বন্ধ হইয়া যায়। সরকার ভুলিয়াছে, শিক্ষকেরা সরকারি তহবিল হইতে বেতন পাইলেও, তাঁহারা সরকারি কর্মী নহেন। স্কুলগুলিও সরকারি কার্যালয় নহে।

তবে এই রায় দেখাইয়া শিক্ষকদের ভূমিকা খণ্ডিত বা সঙ্কীর্ণ করিয়া দেখিলে ভুল হইবে। পাঠদান বিদ্যালয়ের প্রধান কাজ, কিন্তু তাহা একমাত্র কাজ নহে। শিশুদের সার্বিক বিকাশের নানা কর্মসূচি রাষ্ট্র অর্পণ করিয়াছে বিদ্যালয়কে। শিশুর পুষ্টিবিধান, তাহার পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস নির্মাণ, নানাবিধ নির্যাতন ও বঞ্চনা হইতে তাহার সুরক্ষা, সকলই স্কুলের কর্তব্য। শিশুর প্রতি অন্যায় না হয়, তাহার প্রতি সতত সতর্ক থাকিবেন শিক্ষক। পাঠদান ও পরীক্ষাগ্রহণের কাজেই তিনি সর্বতো আবদ্ধ নহেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE