কয়েক দিন আগে একটা চিঠি পেলাম। একটি লেখা সম্পর্কে তীব্র আপত্তি জানিয়ে পাঠানো চিঠি। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লিতে ২০১২ ডিসেম্বরের পৈশাচিক গণধর্ষণের অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরে সেই লেখায় প্রশ্ন তুলেছিলাম, অপরাধীর প্রাণ হরণ করলেই কি অপরাধের ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ হয়? নাকি, এমন ভয়াবহ অপরাধের সুবিচার কিসে হয়, সেটা জানেন না বলেই মৃত্যুদণ্ডের সমর্থকরা ‘ফাঁসি হলেই শান্তি, ব্যস’ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেন? পত্রলেখক এই প্রশ্নে অত্যন্ত বিচলিত হয়েছেন এবং তীব্র তিরস্কারের শেষে ঘোষণা করেছেন, নিজের মেয়ের উপরে ওই রকম অত্যাচার হলে বুঝতাম— কেন মৃত্যুদণ্ডই এর একমাত্র শাস্তি।
ভয়ানক অভিশাপপ্রতিম ওই শেষ লাইনটা পড়ে মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। ভাষার হিংস্রতা, আজও, পীড়া দেয়। কিন্তু ভাষা ও ভঙ্গি যত হিংস্রই হোক, ওই সমালোচকের কথাটি ফেলে দেওয়া যায় না। এবং সেই কথার মূল যুক্তিটি ব্যতিক্রমী নয়, বরং সুপরিচিত। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ছোট বড় নানা উপলক্ষে পরস্পরকে বলে থাকি, ‘বাইরে থেকে অনেক ব্যাপারে অনেক কথা বলে দেওয়া যায়, নিজের হলে বুঝতে!’ আজকাল যে কোনও অপরাধ ঘটলে নির্যাতিত বা তাঁর আত্মীয়স্বজনের মতামত জানতে সংবাদমাধ্যম আকুল হয়ে ওঠে। দর্শক-পাঠকের সংখ্যা বাড়িয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের আকর্ষণের তাগিদটাই হয়তো এই তৎপরতার প্রধান কারণ, কিন্তু তার পাশাপাশি আমরা অপরাধের বিচার ও শাস্তি বিষয়ে আক্রান্ত মানুষ বা তাঁদের ঘনিষ্ঠজনদের মতামত জানতে চাই, সেই মতের একটা বিশেষ গুরুত্বও স্বীকার করে নিই।
এই স্বীকৃতি অসঙ্গত নয়। অপরাধের তদন্ত, বিচার, শাস্তি ইত্যাদি সব কিছুর পরেও জেগে থাকে একটি নির্মম সত্য: যার গেল তার গেল। সেই কারণেই যুক্তি, তথ্য, সাক্ষ্যপ্রমাণের পাশাপাশি আর একটি বস্তুও অত্যন্ত মূল্যবান, তার নাম ‘এমপ্যাথি’। সমানুভূতি। নির্যাতিতের যন্ত্রণার মর্ম অন্য কারও পক্ষে কতটা বোঝা সম্ভব, সে বড় কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু বোঝার চেষ্টা করা নিশ্চয়ই দরকার। সভ্যতা নামে যাকে আমরা জেনে এসেছি, সমানুভূতি তার অন্যতম প্রধান শর্ত।
তবে এই সূত্রে দু’একটি প্রশ্ন ওঠে। এক, এমন অপরাধের শিকার হলেই যে সবাই চরমতম শাস্তির দাবি করেন, সেটা কি বলা চলে? অন্য দৃষ্টান্তও তো আছে। ১৯৯৯ সালে ওডিশায় গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইনস ও তাঁর দুই বালক পুত্রকে নৃশংস ভাবে পুড়িয়ে মেরেছিল যারা, স্বামী ও সন্তানের সেই ঘাতকদের শাস্তি চাননি গ্লেডিস। রাজীব-হত্যার দায়ে দণ্ডিত অন্তঃসত্ত্বা নলিনী মুরুগনের ফাঁসি মকুব করার আবেদন জানিয়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডের এক মায়ের কথা পড়েছিলাম। মেরি ফোলি তাঁর নাম। তাঁর ষোলো বছরের মেয়েকে খুন করেছিল তার এক বন্ধু। জেল হয়েছিল তার, কিন্তু মেরি বলেছিলেন তিনি তাকে মন থেকে ক্ষমা করেছেন, কারণ তা না করলে ‘সারা জীবন আমাকে রাগ আর ঘৃণা বহন করতে হত।’ এমন নানা ঘটনার কথা বিভিন্ন সময়ে পড়েছি, শুনেছি। এ-সব কাহিনি অবশ্যই ব্যতিক্রমী। কিন্তু ব্যতিক্রম আকাশ থেকে পড়ে না। এবং ব্যতিক্রমই সম্ভাবনাকে চিনিয়ে দেয়। অন্য ভাবে ভাবার সম্ভাবনা, ‘সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই’-এর বাঁধা সড়ক ছেড়ে অন্য পথে হাঁটার সম্ভাবনা। মনে রাখতে হবে, এক কালে প্রাণের বদলে প্রাণ নেওয়াকেই সুবিচার বলে মনে করত, এমন অনেক দেশই ক্রমশ মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে— কোনও না কোনও সময়ে কিছু না কিছু মানুষ অন্য পথে হাঁটার কথা না ভাবলে এটা সম্ভব হত না!
দ্বিতীয় প্রশ্নটা আর একটু মৌলিক। ব্যক্তিগত বিপর্যয় সচরাচর আমাদের মনে তীব্র অনুভূতি জাগায়। প্রচণ্ড দুঃখ। প্রচণ্ড ক্রোধ। প্রচণ্ড বিদ্বেষ। এই বিভিন্ন আবেগ একে অন্যের প্রচণ্ডতায় ইন্ধন জোগায়, ফলে তারা আরও আরও আরও প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। অনেক সময়েই আবেগগুলি এমন ভাবে মিলেমিশে থাকে যে, একটিকে আর একটি থেকে আলাদা করা যায় না। এবং ঠিক এই কারণেই সতর্ক থাকা দরকার, আমাদের বিচারবুদ্ধি যেন সেই আবেগের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে না যায়। বিপর্যস্ত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাঁর অনুভূতিকে সম্মান জানানো দরকার, তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা দরকার। সমানুভূতি বাস্তবিকই অতি মূল্যবান। কিন্তু, নিখাদ সোনার মতোই, নিখাদ সমানুভূতি যথেষ্ট নয়, কার্যকারিতার বিচারে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তার সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তির মিশেল দিতে হয়। বিশুদ্ধ, প্রশ্নহীন আবেগ বিচারের চালিকাশক্তি হয়ে পড়লে বিপদ।
শুনেছি, দাঙ্গায় সন্তানহারা এক হিন্দু পিতা গাঁধীজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, মুসলমানরা তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে, তিনি কী ভাবে এর প্রতিশোধ নিতে পারেন। গাঁধীজি উত্তর দিয়েছিলেন, দাঙ্গায় নিহত কোনও মুসলমানের অনাথ সন্তানকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়ে। জানি না, সেই পিতা উপদেশটি পালন করতে পেরেছিলেন কি না। জানি না, গাঁধীজি সম্পর্কে প্রচলিত অনেক কাহিনির মতো এটিও নিছক কাহিনি কি না। কিন্তু সত্য হোক বা গল্প, কথাটা মন দিয়ে মনে রাখার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy