Advertisement
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: শতবর্ষ পেরোনো ভালবাসা
Rabindranath Tagore and Victoria Ocampo

শূন্য কেদারা প্রতীক্ষায়

সান ইসিদ্রোয় কবির বিছানার পাশে থাকত এক আরামকেদারা। জাহাজে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা স্বস্তি পাবেন ভেবে, তাঁর দেশে ফেরার সময় ভিক্টোরিয়া বেপরোয়া হলেন কবির কেবিনে সেটি পাঠাতে।

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:১৫
Share: Save:

২০২৪ নীরবে ছুঁয়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আর্জেন্টিনার সাহিত্যবেত্তা, লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা সুর-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সখ্যের শতবর্ষ। ১৯২৪-এ পেরু যাওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথের। কেন যাওয়া হল না তা নিয়ে কয়েকটি মত প্রচলিত। রবীন্দ্রনাথের শরীর ভাল ছিল না। প্রথম বার চিন ও তৃতীয় বার জাপান ভ্রমণের শেষে, পেরু যাওয়ার পথে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ থেমেছিলেন আর্জেন্টিনায়। অতীতে এক দুঃসময়ে নিজের সঙ্গী হওয়া বই গীতাঞ্জলি-র ঋষি-কবির সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার পরিচয় ছিলই, মনে মনে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সুর পত্রিকায় লেখা এক প্রবন্ধে তাঁর মনে পড়ে, স্বপ্নালোকিত ঘরে পিয়ানোর গায়ে হেলান দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে পড়তে এক দিন থরথর করে কেঁপে উঠেছিল তাঁর যৌবন (অনুবাদ: কেতকী কুশারী ডাইসন)। আর্জেন্টিনায় কবির সঙ্গী ছিলেন সুপুরুষ, তরুণ ইংরেজ কৃষিবিজ্ঞানী লেনার্ড এলম্‌হার্স্ট। তাঁরই মধ্যস্থতায় বুয়েনোস আইরেসের প্লাসা হোটেলে ভিক্টোরিয়া দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

প্রথম দর্শনেই তাঁর সমস্ত শরীর ‘অবশ’ হয়ে এল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেষট্টি, ভিক্টোরিয়ার ছত্রিশ। আবার জাহাজ-যাত্রার আগে, সেই সময় কবির প্রয়োজন ছিল কোনও গ্রামাঞ্চলে কিছুটা বিশ্রামের। সুযোগ ছাড়লেন না ভিক্টোরিয়া। কবিকে এক মনের মতো আস্তানা খুঁজে দেওয়ার ভার কাঁধে নিলেন। কিন্তু বাবা-মায়ের অনুমতি মিলল না সান ইসিদ্রোয় নিজেদের বাড়িতে কবিকে ঠাঁই দেওয়ার। অগত্যা ভাড়া করলেন নিজেদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এক আত্মীয়জনের বাড়ি, নাম ‘মিরালরিও’। সপ্তাহখানেক থাকার পরিকল্পনা থাকলেও রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত সেখানে রয়ে গেলেন প্রায় দুই মাস। ফুলে-ভরা, বাগান-ঘেরা বাড়িটিতে কবির ঘর থেকে দেখা যেত সামনে বয়ে-চলা লা প্লাতা নদী, যেখানে খেলা করে সূর্যাস্তের বিচিত্র, মায়াবী রং। রাত্রে ‘মিরালরিও’ থেকে নিজের বাড়ি ফিরে যেতেন ভিক্টোরিয়া তাঁর বাবা-মায়ের কাছে। দুপুর আর রাতে খাবার আয়োজন করতেন কবির সঙ্গে, নিজের রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম বাড়ি থেকে নিয়ে চলে এসেছিলেন যেখানে। সদাব্যস্ত কবির সঙ্গ প্রত্যাশা করেও ভিক্টোরিয়া যেন কোনও আশঙ্কায় নিজেকে সরিয়ে রাখতেন কিছুটা দূরেই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত এক পুস্তিকায় তিনি লিখছেন, “ওঁর কাছে ভালো হওয়ার জন্য নিজেকে আমি সরিয়ে নিতেও তৈরি ছিলাম” (শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ)।

১৯২৪-এর নভেম্বরে বুয়েনোস আইরেসে রচিত একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, তিনি মনের কথা খুলে বলতে পারেন না, “পাছে আমার একলা প্রাণের ক্ষুব্ধ ডাকে/ রাত্রে তোমায় জাগিয়ে রাখে।” (‘আশঙ্কা’) এই কবিতা তিনি কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন তা অনুমান করা গেলেও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সম্ভবত সেই অনুরাগিণীকেই আবার তিনি এই কবিতায় বলছেন, “দেখেছিলেম, সুপ্ত আগুন লুকিয়ে জ্বলে/ তোমার প্রাণের নিশীথ রাতের/ অন্ধকারের গভীর তলে।” আর্জেন্টিনায়, অসুস্থতার ভিতর, তাঁর অনুরাগিণী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় একটা আনন্দময় সময় কাটিয়ে আবার ফিরে যাওয়ার বিধুর স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতায় রয়ে গিয়েছে। ১৯২৫-এ প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ পূরবী-তে দেখা যায় তেমনই কিছু কবিতা। পূরবী রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকেই। কবি ভিক্টোরিয়ার নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। বইটি ডাকে পাঠিয়েও, ‘বিজয়ার করকমলে’ সেই বই সহস্তে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে, এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন, “এই বইয়ের অনেকগুলি কবিতা লেখা হয়েছিল যখন আমি সান ইসিদ্রোয়। আমার পাঠকেরা যাঁরা এই কবিতাগুলো বুঝবেন তাঁরা কখনওই জানবেন না আমার বিজয়া কে, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এগুলো।” চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি অক্ষরে লিখেছিলেন বাংলা ‘ভালবাসা’। কবি তাঁর আর কোনও সদ্য-চেনা অনুরাগিণীকে নিজের চিঠিতে এত সাহসী ‘ভালবাসা’র স্পষ্ট চিহ্ন এঁকে দিতে পেরেছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন থাকেই। পরিচয়ের এক বছরের মাথায়, ১৯২৫-এর ডিসেম্বরে ভিক্টোরিয়াও হৃদয়-উজাড় করে লেখা এক চিঠির শেষে নিঃসঙ্কোচে তাঁর ‘প্রিয় গুরুদেব’কে লিখেছেন, “আই লাভ ইউ”।

‘আশঙ্কা’ কবিতায় সম্ভবত কোনও এক প্রেয়সীকে নিশীথে তন্দ্রাহারা করে তোলার যে উদ্বেগ রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছিলেন, ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিচারণ যেন চিনিয়ে দিল সেই উতলা নিশীথিনীকেই। ভিক্টোরিয়া লিখছেন, “অল্পে অল্পে বুঝে নিলাম মানুষ রবীন্দ্রনাথকে, ধরতে পারলাম ওঁর চালচলন। অল্পে অল্পে রবীন্দ্রনাথও বশ করে নিলেন একাধারে বন্য আর নিরীহ এই নবীন প্রাণীটিকে। রাত্রিবেলায় যে-কোনো গৃহপালিতের মতো তাঁর দরজার বাইরে মেঝের টালির উপর যে শুয়ে থাকতাম না, তার একমাত্র কারণ এই যে ব্যাপারটা খুব ভালো দেখায় না!” (অনুবাদ: শঙ্খ ঘোষ)। পূরবী-র ‘অন্তর্হিতা’ কবিতায় দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ কোনও এক অপেক্ষমাণ অতিথিকে দরজার আগল খুলে দিতে চেয়েও ঘুমের ঘোরে ভুলে যাচ্ছেন, লিখছেন, যেন মন তাঁকে জিজ্ঞাসা করছে, “কোন অতিথি দ্বারের কাছে/ একলা রাতে বসে আছে...”

সান ইসিদ্রোয় রবীন্দ্রনাথ মেতে ছিলেন নিজের লেখায় ভুল হওয়া অংশ চাপা দিয়ে আঁকতে থাকা নানা নকশায়। এক দিন ভিক্টোরিয়ার হাতে পড়ল বাংলায় লেখা, অদ্ভুত সব কাটাকুটির নকশায় ভরা একটা খাতা। ভিক্টোরিয়া তার ভিতরেই খুঁজে পেলেন ভবিষ্যতের এক চিত্রকরকে, আর তাই যেন উস্কে দিলেন কবির ভিতর লুকিয়ে থাকা চিত্রশিল্পীকেই। বাংলা লিপির সৌন্দর্য আর রবীন্দ্রনাথের কাটাকুটির অনন্যতায় মোহিত হয়ে, আবদার করে তুলে রেখেছিলেন সেই খাতার কয়েকটি পৃষ্ঠার আলোকচিত্রও। ভিক্টোরিয়ার মতে, সেই ছোট খাতাটিই হল শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব: “কবিতার মধ্যে শব্দ খোঁজা ব্যাপারটাকে রেখায় রূপান্তর দেওয়া থেকেই এই শিল্পের জন্ম” (অনুবাদ: শঙ্খ ঘোষ)। ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথ ফ্রান্সে গেলেন, সঙ্গে তাঁর নিজের আঁকা শতাধিক ছবি। একই সময়ে সেই দেশে তখন ভিক্টোরিয়া। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে, প্রবাসে নিজের চিত্রকলার একটা প্রদর্শনী হোক। অথচ দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছাড়া কোনও ‘গ্যালারি’ ফাঁকা পাওয়া দুষ্কর। কবি শরণাপন্ন হলেন ভিক্টোরিয়ার। ভিক্টোরিয়া দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের কাটাকুটির ‘সেই খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’। ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত পরিচিতির বিস্তার ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁরই উদ্যোগে এবং আর্থিক সহায়তায়, পিগাল থিয়েটারের প্রদর্শনীকক্ষে আয়োজিত হল রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী। ভিক্টোরিয়ার হাত ধরে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের নবজন্ম হল বিদেশে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, ছবি, ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিমূলক নিবন্ধ এবং সর্বোপরি পরস্পরকে লেখা চিঠিপত্রই ইঙ্গিত দিয়ে যায় দু’জনের ভিতর গড়ে ওঠা এক বিরল, গহিন ভালবাসার সম্পর্কের, যার অনুক্ত ইতিহাস আজও রহস্যে আবৃত। শুধু পাঠক জেনেছে, কবির সেই ‘বিজয়া’ কে!

সান ইসিদ্রোয় পৌঁছেই, ১৮৯৫-এ লেখা একটা গান রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করে উপহার দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়াকে— ‘চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’। আর্জেন্টিনার শীতে কাঙ্ক্ষিত উষ্ণতা এনে দিতে এক শ্রেষ্ঠ পোশাক নির্মাতাকে দিয়ে সবচেয়ে মহার্ঘ পশমে আদরের কবিকে একটা জোব্বা বানিয়ে দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া। বহুদিন পরেও রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষ থেকে বিজয়াকে পাঠিয়েছেন সেই জোব্বা পরা তাঁর নিজের ছবি। রবীন্দ্রনাথ আর ভিক্টোরিয়ার কয়েকটা আলোকচিত্র পাওয়া যায়। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহে তারই অন্তত তিনটিতে রবীন্দ্রনাথের পাশে এক পরিযায়ী, পলাতকা পাখির মতো আসা বিজয়ার মুখে কেন কালির আঁচড় (ছবি), যাকে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন ভিক্টোরিয়ার ‘স্বহস্তকৃত কলঙ্কলাঞ্ছন’? কোন পরাজয়ের ক্লান্তিতে কবির বিজয়া মুখ ঢাকলেন আড়াল প্রার্থনা করে? মেলে না উত্তর।

রবীন্দ্রনাথ খুব চেয়েছিলেন, ভিক্টোরিয়া ভারতে আসুন। লিখেছিলেন, “ভেবেছিলেম বলি তোমায়, সঙ্গে চলো/ আমায় কিছু কথা বলো।” (‘আশঙ্কা’) ভিক্টোরিয়া যেতে পারেননি কবির আশ্রমে। লিখেছিলেন, “কোনো দিন তাঁকে দেখা হল না তাঁর নিজের বাড়িতে, যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন” (অনুবাদ: কেতকী কুশারী ডাইসন)। ১৯৩০-এ প্যারিসের এক রেলস্টেশনেই কবির সঙ্গে শেষ দেখা, সেখানেই দু’জনের অন্তিম আলিঙ্গন। সান ইসিদ্রোয় কবির বিছানার পাশে থাকত এক আরামকেদারা। জাহাজে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা স্বস্তি পাবেন ভেবে, তাঁর দেশে ফেরার সময় ভিক্টোরিয়া বেপরোয়া হলেন কবির কেবিনে সেটি পাঠাতে। জাহাজের সঙ্কীর্ণ দরজা দিয়ে কিছুতেই আর ঢোকে না বিপুলায়তন আরামকেদারা, ‘হুলিয়ো সেসর’ জাহাজের দরজা খুলিয়ে ভিক্টোরিয়া দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় কবির সঙ্গী হিসেবে রেখে এলেন তাকে, নিজের বদলে। ১৯৪১ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে শূন্য চৌকিকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের এক কবিতায় যেন ধ্বনিত হল ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পর বহু বছর জুড়ে তাঁর হৃদয়ে ঘনীভূত একাকী মেঘের বিরহ-বেদনা: “শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর।”

শতবর্ষ অতিক্রান্ত। উত্তরায়ণের উদয়নে, কবির শূন্য ভবনে আজও এক প্রিয় বিদেশিনির অপেক্ষায় সান ইসিদ্রো থেকে শান্তিনিকেতনে নীড় খুঁজে পাওয়া, নিবিড় ভালবাসার স্পর্শে সিক্ত এক জীর্ণ, রিক্ত কেদারা।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Victoria Ocampo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy