Advertisement
১৩ অক্টোবর ২০২৪
World Happiness Report

World Happiness Day: বিশ্ব সুখ দিবস: ‘সবচেয়ে সুখী’ দেশগুলির অগণিত অ-সুখী মানুষের কাহিনি

কী করে ‘সুখ’-এর মতো একটি আদ্যন্ত বিমূর্ত বিষয় নির্ধারিত হয়, তা বুঝে ওঠা দুরূহ। মূল খেলাটি খেলে থাকে সংখ্যাতত্ত্ব। ‘সুখ’-এর মাপকাঠি হিসেবে এই সমীক্ষায় এমন কিছু প্রশ্ন রাখা হয়, যা চরিত্রগত ভাবে বস্তুতান্ত্রিক এবং আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। পরিবার, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ বা যৌনতার মতো বিষয়গুলি উহ্যই থেকে যায়।

ছটফট করে সারা বিশ্ব। সরকারি নথি দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা যায় না।

ছটফট করে সারা বিশ্ব। সরকারি নথি দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা যায় না। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২২ ১৪:২৭
Share: Save:

‘সুখের কথা বোলো না আর...’ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান)

‘মহাভারত’-এর বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রতি বকরূপী যক্ষের শেষ প্রশ্ন ছিল— এ জগতে সুখী কে? যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেছিলেন, অঋণী-অপ্রবাসী অবস্থায় যে ব্যক্তি দিনান্তে শাকান্ন ভক্ষণ করে, সে-ই প্রকৃত সুখী। ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। এ দিন যদি ‘মহাভারত’-এর এই প্রসঙ্গ কারও মাথায় আসে, তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে হাসবেন। দেনায় নিমজ্জিত ইএমআই গুনতে থাকা মানুষ দিনের মধ্যে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে দিনান্তে বিস্বাদ প্রিজার্ভেটিভ মাখানো খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে ভক্ষণ করতে করতে আর যাই হোক ‘সুখী’ থাকে না। থাকার কথাও নয়। তবু রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে কাজ করা একটি সংস্থা এই বিশেষ দিনটির প্রাক্কালে একটি তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বিশ্বের দেশগুলিকে ‘সুখ’-এর নিরিখে ক্রম অনুসারে সাজানো হয়। ‘সুখ’ থেকে তালিকা ক্রমে গড়াতে থেকে ‘অ-সুখ’-এর দিকে।

এ বছরও সুখের তালিকায় ভারত একেবারে নীচের দিকে অবস্থান করছে। ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৬ নম্বরে। ২০২১-এর হিসেব মোতাবেক ভারতের স্থান ছিল ১৩৯-এ। ২০১৯-এ ১৪০। পাকিস্তানও তালিকায় ভারতের থেকে উপরে। এ বছর তাদের স্থান ১০৫-এ।

প্রশ্ন জাগতেই পারে, কিসের ভিত্তিতে নির্ণিত হয় বিষয়টি? আর কারাই বা নির্মাণ করেন এই তালিকা? রাষ্ট্রপুঞ্জের জন্য কাজ করা ‘সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক’ এই রিপোর্টটি পেশ করে। রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা সুখী কি না। পাশাপাশি হিসেবনিকেশ চলে সমীক্ষাধীন দেশগুলির আর্থিক বৃদ্ধির হার, দেশবাসীর গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, কাজ করার স্বাধীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। এই সমীক্ষায় যুক্ত থাকে পশ্চিমের বেশ কিছু গবেষণা সংস্থা।

উপরোক্ত হিসেবনিকেশ থেকে কী করে ‘সুখ’-এর মতো একটি আদ্যন্ত বিমূর্ত বিষয় নির্ধারিত হয়, তা বুঝে ওঠা দুরূহ। সামান্য তলিয়ে ভাবলেই প্রশ্ন জাগে, ‘সুখ’-এর মতো এক একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কী করে সামূহিক চেহারা প্রদান করা যায়? এখানে মূল খেলাটি খেলে থাকে সংখ্যাতত্ত্ব। লক্ষণীয় এই যে, ‘সুখ’-এর মাপকাঠি হিসেবে এই সমীক্ষায় এমন কিছু প্রশ্ন রাখা হয়, যা চরিত্রগত ভাবে বস্তুতান্ত্রিক এবং আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। মোটামুটি শান্তি, রোটি-কাপড়া-মকানের খানিক বন্দোবস্ত, সেই সঙ্গে সরকার কর্তৃক সহায়তা— এই সব কিছু থেকেই উঠে আসে ‘সুখে থাকা’-র মাপকাঠি। এমন হিসেবে রাষ্ট্রমুখীনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়। পরিবার, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ বা যৌনতার মতো বিষয়গুলি উহ্যই থেকে যায়।

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-এ ভারত বা তার মতো দেশগুলির উপরের দিকে উঠে আসার ব্যাপার-স্যাপার যে ঘটবে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। দারিদ্র, কর্মনিযুক্তির অভাব বা ছদ্ম কর্মনিযুক্তির মতো ঘটনা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-নেপাল ইত্যাদি রাষ্ট্রে যে আকছার, তা নতুন করে বলার নয়। একই কথা প্রযোজ্য আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির ক্ষেত্রেও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তালিকায় উপরের দিকে বিরাজমান দেশগুলির অধিকাংশই উত্তর ইউরোপের রাষ্ট্র। ২০২২-এর সুখ-তালিকার উপরের দিকে থাকা দেশগুলি হল— ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি। সন্দেহ নেই, কম জনসংখ্যার এই দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় পরিষেবার সুযোগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তার পরেও কিছু খটকা থেকেই যায়।

সুখ-তালিকার মাপকাঠিগুলি, অর্থাৎ গণ-সমীক্ষার ছক থেকে বেরিয়ে এসে যদি সাংস্কৃতিক কিছু পরিসরে অনুসন্ধান করা যায়, তা হলে বেশ গোলমেলে ছবি উঠে আসে। সুখ-তালিকা পেশ হচ্ছে গত ১০ বছর ধরে। আর এই দশকটির কিছু আগে থেকেই সুখ-তালিকায় সবচেয়ে উপরে থাকা উত্তর ইউরোপের দেশগুলি, যারা ‘নর্ডিক কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত, সেখানে এক বিশেষ বিধার সাহিত্যচর্চা পরিলক্ষিত হয়। এই সাহিত্য মূলত রহস্যকাহিনি। কিন্তু তার মধ্যে ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় চর্চিত রহস্যকাহিনির চেনা ফর্মুলা অনুপস্থিত। ‘নর্ডিক নয়্যার’ নামে পরিচিত এই আখ্যানগুলির চরিত্র অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। ব্যক্তিমানুষ সেখানে রাষ্ট্রীয় তথা প্রশাসনিক চাপে দীর্ণ। আর তার পাশাপাশি বহমান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের ফলে জাত বেশ কিছু সমস্যা, যা সেই সব দেশের মানুষের জীবনকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার, নর্ডিক নয়্যার-এর আখ্যান কাঠামো ক্রমে প্রবেশ করেছে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের সাহিত্যেও। সেখানেও মুহুর্মুহু দেখা মিলতে শুরু করে অ-সুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের।

১৯৯০-এর দশকে সুইডেনের লেখক হেনিং ম্যানকেল তাঁর কার্ট ওয়াল্যান্ডার সিরিজ লিখতে শুরু করেন। সেখানে রহস্যসন্ধানী এবং অপরাধী— উভয়েই নিঃসঙ্গতা থেকে শুরু করে ড্রাগ সেবন, অবসাদজনিত কারণে আইন-বহির্ভূত জগতে পা রাখা ইত্যাদির শিকার। ওয়াল্যান্ডার গোয়েন্দা। কিন্তু সে তার শিল্পমনস্ক বাবা বা প্রেমিকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। অন্য দিকে ওয়াল্যান্ডার যাদের পিছনে ধাওয়া করে, তারাও যে ‘অপরাধ’ ঘটিয়ে চলে নিতান্ত স্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে, এ কথা বলা যাবে না। একটি ছোটগল্পে ওয়াল্যান্ডার এক গ্রোসারি স্টোরে মুখোমুখি হয় এক আফ্রো-বংশোদ্ভূত খুনির, যে খুন করে তার উপরে ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রিক অন্যায়ের পাল্টা জবাব হিসেবে। সে কতখানি ‘অপরাধী’— এই প্রশ্ন ম্যানকেল পাঠকের সামনে অমীমাংসিত রেখে দেন।

একই রকম ভাবে স্টিগ লারসন তাঁর ‘মিলেনিয়াম ট্রিলজি’-তে তুলে আনেন লিজবেথ স্যালান্ডার নামের একটি মেয়েকে, যে বাল্যকাল থেকেই বিবিধ অ-সুখে দীর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সে দেশের সরকারের মদতপুষ্ট মাফিয়ারা (মূলত ড্রাগ-ব্যবসায়ী ও নারীপাচারের কাজে জড়িত) উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয় এবং আশ্রয়দাতা দেশগুলির দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের মদতপুষ্ট হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। লারসন তাঁর ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু’, ‘দ্য গার্ল হু প্লেড উইথ ফায়ার’ এবং ‘দ্য গার্ল হু কিকড দ্য হর্নেটস নেস্ট’-এ তুলে ধরেছিলেন রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, কর্পোরেট জগতের ছায়াচ্ছন্নতা এবং শেষ পর্যন্ত পারিবারিক ও যৌন হিংসার এমন সব ছবি, যা সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে। এক সুবিশাল পাপচক্রের সঙ্গে একটি মেয়ের একক লড়াইয়ের এই ত্রয়ী উপন্যাস কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে। একই সঙ্গে লারসন সুইডিশ গণমাধ্যম ও তার তলায় তলায় বয়ে যাওয়া হিংসা ও প্রতিহিংসার আখ্যানকেও তুলে ধরেন। এই ট্রিলজির সাংবাদিক নায়ক মাইকেল ব্লুমকভিস্টের নিঃসঙ্গতা ও এক অবসাদগ্রস্ত জীবন কোন ‘সুখ’-এর কথা বলে, তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

আইসল্যান্ডের লেখক আর্নলডুর ইন্ড্রিডাসন এই মুহূর্তে তাঁর রচনাশৈলীর গুণে নজর কেড়েছেন আবিশ্ব পাঠকের। তাঁর ‘ডিটেক্টিভ এরলেন্ডুর’ সিরিজে গোয়েন্দা ও অপরাধী, উভয়েই ভয়াবহ অবসাদের শিকার। পটভূমিকা মাঝে মাঝেই এমন ঘন কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত হয়ে ওঠে যে, পাঠকও ডুবতে থাকেন সেই সব অ-সুখে। তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘জার সিটি’ একটানা পড়তে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, এমন অভিজ্ঞতা অগণিত পাঠকের।

‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু’ (২০০৯) এবং ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ (২০১৬) ছবির পোস্টার।

‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু’ (২০০৯) এবং ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’ (২০১৬) ছবির পোস্টার।

একই কথা প্রযোজ্য নরওয়ের লেখক জো নেসবো সম্পর্কেও। নেসবোর হ্যারি হোল সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্যাট’-এর পটভূমিকা অস্ট্রেলিয়া। ‘অ্যাবঅরিজিন’ হিসেবে চিহ্নিত অস্ট্রেলীয় মানুষ কী বিপুল বঞ্চনা আর অবমাননার মধ্যে বেঁচে আছেন, তা এই উপন্যাসে তিনি তুলে আনেন। গোয়েন্দা হ্যারি হোলও সুখী বা তৃপ্ত মানুষ নয়। বার বার সে সম্মুখীন হয় ‘মানবতা’ নামে প্রচারিত এক বিমূর্ত ধারণার চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ার ঘটনার। স্বস্তি দেয় না এই সব লিখন। শার্লক হোমস বা এরক্যুল পোয়ারো-র উপন্যাসের উষ্ণতাপৃক্ত আরাম এই সব লেখায় নেই। নেই নেসবোর সিরিজ-বহির্ভূত উপন্যাসগুলিতেও। সম্প্রতি নেসবো পুনর্নির্মাণ করেছেন শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর। ইংরেজ নবজাগরণের কালে লিখিত ম্যাকবেথ এখানে অছিলা মাত্র। ১৯৭০ দশকে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রক্ষিতে জন্মানো অপরাধজগৎ ও তার গূঢ় ও গাঢ় রসায়ন জানায়, নরওয়ের আজকের অসুখগুলির পশ্চাৎভুমিকে।

সুইডিশ রহস্য কাহিনির আর এক প্রাণপুরুষ হাকান নেসেরের গোয়েন্দা ভ্যান ভেটেরানও এক নিঃসঙ্গ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক। বিবাহবিচ্ছিন্ন। সে তার ছেলেকে হারিয়েছে সম্পূর্ণ এক কাকতালীয় ঘটনায়। আর সে যে সব রহস্যে জড়িয়ে পড়ে, তার মূলে থেকে যায় অগণিত অ-সুখী মানুষের কাহিনি। কেউ বিনা কারণে দীর্ঘ কারাবাস থেকে বেরিয়ে আসে, কেউ বা যৌনবিকৃতির শিকার হয়ে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। নেসেরের উপন্যাসমালাতেও কোনও স্বস্তি নেই। ‘সুখ’ নামের বস্তুটি একেবারেই অনুপস্থিত।

‘মিলেনিয়াম ট্রিলজি’-তে লিজবেথ স্যালান্ডারের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন নুমি রাপাচে।

‘মিলেনিয়াম ট্রিলজি’-তে লিজবেথ স্যালান্ডারের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন নুমি রাপাচে।

এ ভাবে দেখতে গেলে তালিকা লম্বা হতে থাকবে। ডেনমার্কের পিটার হোয়েগ, সুইডেনের ক্যামিলা ল্যাকবার্গ প্রমুখ তাঁদের লেখায় ক্রমাগত লিখে চলেছেন অ-সুখের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহকে। হ্যারি পটার-রচয়িতা জেকে রাওলিং যখন রবার্ট গ্যালব্রেথ ছদ্মনামে ক্যামেরন স্ট্রাইক সিরিজ লিখলেন, বোঝা গেল অ-সুখের ঠিকানা ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। স্ট্রাইক গোয়েন্দা বটে, কিন্তু সে নিজেই একজন আপাদমস্তক বিষাদগ্রস্ত মানুষ। অন্য দিকে চোখ ফেরালে বোঝা যায়, রাওলিংয়ের হ্যারিও কি সুখী? সেই কাহিনিমালার খলনায়ক ভোলডেমর্টও কি তীব্র অ-সুখে ভোগা এক চরিত্র নয়? ২০১৫-এ ইংরেজ লেখিকা পলা হকিন্স তাঁর রহস্যোপন্যাস ‘দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন’-এ যে আত্মবিড়ম্বিত, নেশায় আমাথানখ চুবে থাকা বিষাদময়ী মেয়েটিকে নিয়ে এলেন, সেই র‍্যাচেল ওয়াটসন কোন সুখ-নগরের বাসিন্দা?

সাহিত্য গণমানসের দর্পণ। পরিসংখ্যান রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা নথি। এই দুই বস্তু কদাচিৎ মিলিত হয়। ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালির সুখের ধারণা কালে কালে বদলেছে, ‘বিষবৃক্ষ’-এর কুশীলবের অ-সুখ মোটেই মিলবে না সমরেশ বসুর ‘বিবর’-এর অ-সুখের সঙ্গে। তবু নেটমাধ্যমে ক্রমাগত ছবি আর ইমোজি সাঁটতে থাকা বাঙালি এই মুহূর্তে যেন এক বিভ্রান্তিকেই আঁকড়ে ধরেছে ‘সুখ’-এর নামে। হ্যাপিনেস রিপোর্ট এই বিভ্রান্তির কথা বলে না। বলতে পারে না। সে শুধু কিছু সংখ্যা দেখিয়ে নীরব হয়ে যায়। এই নীরবতার মধ্যে ঘেঁটে যাওয়া ভারতীয়-পাকিস্তানি- বাংলাদেশি বা মায়ানমারের মানুষ তার দিনযাপনের ক্ষতগুলিকে ঢাকতে আরও আরও বেশি করে হাসিমুখের নিজস্বী পোস্ট করে সমাজমাধ্যমে। এরই মাঝে কোথাও আর্তির মতো পাক খায় এক চেনা গানের সুর, যেখানে সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, বিশদ জোছনায় মাথা কুটছে অ-সুখ। রাতের নির্ঘুমতায় ছটফট করে সারা বিশ্ব। সরকারি নথি আর এফএকিউ (ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চনস) দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা যায় না।

(গ্রাফিক: সনৎ সিংহ)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE