পথ বন্ধ করিয়া এক দল মানুষ নমাজ পড়িতে বসিলে অন্যদের অসুবিধা হইতেই পারে। কতখানি অসুবিধা? রাস্তা আটকাইয়া দুর্গা পূজা করিলে যতখানি অসুবিধা হয়, অথবা রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে রাজপথের অর্ধেক বন্ধ করিয়া দিলে বা নেতারা মিটিং ডাকিলে যতখানি, অনুমান করা চলে, নমাজ-সৃষ্ট অসুবিধার পরিমাণ তাহার তুল্য। বস্তুত, খানিক কম হওয়ারই কথা। কারণ, নমাজ প়়ড়িবার জন্য টানা সাত দিন রাস্তা আটকাইয়া রাখিবার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, এই পার্থক্যটি সত্ত্বেও, অন্য কারণগুলিতে রাস্তা আটকানো যতখানি আপত্তিজনক, নমাজের ক্ষেত্রেও ততখানি আপত্তি করিবার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। গুরুগ্রামে সংযুক্ত হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির বাহুবলীরা কি এই অসুবিধার কারণেই শহরের অন্তত দশটি এলাকায় নমাজ পড়া বন্ধ করিয়াছেন? সম্ভবত তাহা নহে। মুসলমানদের প্রকাশ্যে উপাসনা করিতে দেখিয়া তাঁহাদের হিন্দুত্ববাদী ভাবাবেগে আঘাত লাগিয়াছে বলিয়াই অনুমান। সভ্য সমাজে এই গোত্রের আপত্তির একটিই উত্তর হয়: কেহ রাস্তায় নমাজ পড়িতেছে দেখিলে যদি সমস্যা হয়, তবে অন্য রাস্তা দিয়া যান। কেহ যদি গায়ের জোরে অসুবিধার কথা জানাইতে চাহেন, তবে পুলিশ তাঁহাকে সংযত করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। কিন্তু, এই দেশ এখন নরেন্দ্র মোদীদের। ফলে, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টার জানাইয়া দিয়াছেন, নমাজ পড়িতে হইলে মসজিদে, অথবা ব্যক্তিগত পরিসরে, পড়াই ভাল। তাঁহার বার্তাটি পাঠ করিতে হিন্দুত্ববাদীদের অসুবিধা হয় নাই। তাঁহারা জানাইয়াছেন, ফের কেহ গণপরিসরে নমাজ পড়িলে তাঁহারা ফের বাধা দিবেন। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে মুসলমানদের প্রকাশ্যে ধর্মাচরণের অধিকার থাকিতে পারে না।
একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যখন প্রকাশ্য নমাজ পড়িবার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হইতেছে, তখন তাঁহার এ হেন উক্তির তাৎপর্য কী, তাহা না বুঝিবার মতো অবিবেচক মনোহরলাল খট্টার নহেন। অন্তত, তাঁহার রাজনৈতিক জীবনে তেমন বুদ্ধিহীনতার কোনও প্রমাণ নাই। অতএব, ধরিয়া লওয়া যায়, তিনি যাহা বলিয়াছেন, বুঝিয়াই বলিয়াছেন। তাঁহার কথায় মুসলমানরা আরও সমস্যায় পড়িবেন, বৈষম্যের শিকার হইবেন, তাহা জানিয়াই খট্টার কথাগুলি বলিয়াছেন। স্পষ্টতই, তাঁহার দায়বদ্ধতা সংবিধানের প্রতি নহে। রাষ্ট্রের চক্ষে নাগরিকের সমান অধিকার বা প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মাচরণের অধিকার রক্ষায় তিনি আগ্রহী নহেন। তাঁহার দায়বদ্ধতা নাগপুরের প্রতি, গোলওয়ালকরের আদর্শের প্রতি। ভারতীয় রাষ্ট্রে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করিবার প্রকল্পটিতে তিনিও সাগ্রহ শরিক। কারণ, তিনি জানেন, দেশের সর্বোচ্চ আসনটিতে যিনি বসিয়া আছেন, তাঁহার নাম জওহরলাল নেহরু নহে, নরেন্দ্র মোদী।
নেহরু ও মোদীর তুলনা অ-সম্ভব, কিন্তু সেই তুলনা না টানিয়াও উপায় নাই। রাষ্ট্রীয় পরিসরে তো বটেই, নেহরু গণপরিসরেও যে কোনও ধর্মাচরণকে অবাঞ্ছিত জ্ঞান করিতেন। কিন্তু, তিনি জানিতেন, দেশভাগ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাক্রম ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও ভীতির সঞ্চার করিয়াছে, তাহা দূর করিতে হইলে রাষ্ট্রকে মুসলমানদের রক্ষকের ভূমিকা লইতে হইবে। তাঁহারা সংখ্যালঘু বলিয়াই অনেক বেশি ছাড় দিতে হইবে। গত চার বৎসরে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হইয়াছে, তাহা সামান্য নহে। এবং, এই ভীতির মূল কারণ, মুসলমানরা ক্রমেই টের পাইতেছেন, রাষ্ট্র তাঁহাদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করিতেছে। খট্টারের উক্তিটি যেমন। এই মারাত্মক প্রবণতা ঠেকাইবার সাধ্য এক জনেরই ছিল। কিন্তু, হায় ভারত, নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে যে জওহরলাল নেহরু হইয়া উঠা অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy