Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

প্রচারের নীচে

তাহাদের রাজনীতি যতখানি, অধিকাংশ সময় তাহাদের প্রচারের রাজনীতি তদপেক্ষা বেশি গুরুতর। প্রচার বিষয়টি গণতন্ত্রের অঙ্গাঙ্গি অংশ, সুতরাং কালের অবশ্যম্ভাবিতায় ইহা ভারতীয় রাজনীতিতে বড় স্থান করিয়া লইবে, ইহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই।

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ভারতীয় জনতা পার্টি এত দিনে তাহার একটি বৈশিষ্ট্য লোকসমক্ষে স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে: প্রচার বস্তুটিকে তাহারা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে। তাহাদের রাজনীতি যতখানি, অধিকাংশ সময় তাহাদের প্রচারের রাজনীতি তদপেক্ষা বেশি গুরুতর। প্রচার বিষয়টি গণতন্ত্রের অঙ্গাঙ্গি অংশ, সুতরাং কালের অবশ্যম্ভাবিতায় ইহা ভারতীয় রাজনীতিতে বড় স্থান করিয়া লইবে, ইহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। তবে লক্ষণীয় হইল, বিজেপি এই বিষয়টিতে যতখানি উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, তাহার কাছাকাছি কোনও দলই পৌঁছাইতে পারে নাই। গোড়ার এই কথাটি মনে রাখিয়া যদি বিজেপির সাম্প্রতিক কার্যক্রম লক্ষ করা যায়, প্রচারের বাস্তব আর প্রচারতলে নিহিত সত্যকারের বাস্তবের মধ্যে একটি দূরত্ব নজরে আসিবে। এই যেমন, গত সপ্তাহান্ত হইতে জনরব, বিজেপি না কি ত্রিপুরাসহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতকে ‘প্লাবিত’ করিয়া দিয়াছে। কেবল প্রচারমাধ্যম বা দলীয় মুখপত্র এই ঘোষণা করিতেছে না, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নূতন ‘ওয়েভ’-এ ভাসিতে ভাসিতে সংসদে পদার্পণ করিতেছেন। এই আত্মসন্তোষের পিছনে তথ্য-পরিসংখ্যান কী বলিতেছে, এক বার তলাইয়া দেখা ভাল। বিজেপির কৃতিত্বকে খাটো করিবার প্রশ্নই নাই। ২০১৪ সালের আগে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি রাজ্যেও বিজেপির সরকার ছিল না, বিধানসভায় আসনও ছিল যৎসামান্য। ভোটের দুই শতাংশেরও কম ছিল তাহার বাক্সে। সেখান হইতে এ বারের নির্বাচনে ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয় তিন রাজ্য মিলিয়া বিজেপি পাইয়াছে সাড়ে ছাব্বিশ শতাংশ ভোট। ত্রিপুরায় ৬০টি আসনের মধ্যে ৩৫টি পাইয়াছে, যাহার অর্থ, সরকার গড়িতে বিজেপি সেখানে একাই একশত। বিজেপি যতগুলি আসনে লড়িয়াছে, তাহার ৭০ শতাংশে জয় আসিয়াছে। ইহাকে ‘সুইপ’ বলিলে ভুল হইবে না।

কিন্তু ত্রিপুরা জয় করা ও উত্তর-পূর্ব ভারত ভাসাইয়া দেওয়ার মধ্যে বেশ বড় পার্থক্য আছে। মেঘালয়ে অনেক লড়িয়াও দুটি আসনের বেশি বিজেপির পকেটে আসে নাই, অর্থাৎ সেখানকার জনমত বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না। ভোটের আগে সে রাজ্যের নানা অঞ্চলে গোমাংস-বিদ্রোহী বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষ রাগত বিক্ষোভ দেখাইয়াছে, ভোটের পরও স্পষ্ট যে সেখানকার ব্যালট বিজেপিকে সমর্থন জোগায় নাই। ২১টি আসন পাইয়াছে কংগ্রেস। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাহা যথেষ্ট নহে। সেই সুযোগেই অন্যান্য দলের সহিত বিজেপি হাত মিলাইতে পারিতেছে। তবে কনরাড সাংমার নূতন সরকার কিন্তু বিজেপি-সমর্থনে এনপিপি-র সরকার, তাহার উলটাটি নহে। নাগাল্যান্ডেও বহুমুখী সরকারের মধ্যে বিজেপি অন্যতম মুখ, এইমাত্র। আঞ্চলিক দলগুলির সহিত জোট বাঁধিয়া জাতীয় দল আত্মরক্ষা করিতেছে, এমন ঘটনা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে নূতন নহে। কিন্তু তাহা করিতে গিয়া নিজের কৃতিত্বকে ‘ওয়েভ’ বলিয়া অন্য কেহ আগে দাবি করে নাই।

জোট বাঁধিয়া সরকার গঠন যেমন প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বাস্তব, জোটের কারণে রাজনৈতিক সংকটের পারাবারে তলাইয়া যাওয়াও তেমনই বহুপরিচিত ঘটনা। ইতিমধ্যেই নাগাল্যান্ডে জোট-বোঝাপড়ার সংকট শুরু হইয়া গিয়াছে। সেই সংকটের মধ্যে বিজেপি এখন অন্যতম শক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল, সংবাদ এইটুকুই। অতিরিক্ত গৌরবায়নে বিজেপি নিজের মুখোজ্জ্বলের চেষ্টা করিতে পারে, তবে তাহা সত্যানুগ হইবে না। একটি কথা অবশ্য মানিতেই হইবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিবাসীদের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ, তাঁহারা দেশের মূলস্রোত হইতে বিচ্ছিন্ন। সাম্প্রতিক রাজনীতির বাঁকে তাঁহাদের ক্ষোভ ঘুচিবার কথা। উত্তর-পূর্ব ভারত এখন কেবল ভারতীয় মূলস্রোত রাজনীতির অংশ নহে, অন্যতম চালিকাও বটে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE